ভিক্তর, কিয়েভে আমার প্রাক্তন সহপাঠীর কাছ থেকে শেষ বার্তাটি পেয়েছি ২৪ ঘণ্টা আগে। ও জানিয়েছে, স্ত্রী ও মেয়েকে শহরের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। চাইলে সে-ও যেতে পারত, অনূর্ধ্ব ৬০ বছর বয়সী সবল মানুষকে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ‘আমি এখনো সবল, এই যুদ্ধে আমার করার অনেক কিছু আছে, আমি শেষ না দেখে যাব না,’ ভিক্তর লিখেছে।
ইতিমধ্যে চার দিন কেটে গেছে। ভাবা হয়েছিল, রাতারাতি জেলেনস্কি সরকারের পতন হবে, তার স্থানে একটি মস্কোপন্থী সরকার গঠন করে রাশিয়া তার সৈন্যদের ফিরিয়ে নেবে। কাজটি ত্বরান্বিত করতে পুতিন ‘নাৎসি ও মাদকাসক্ত’ জেলেনস্কি সরকারের বিরুদ্ধে অবিলম্বে অস্ত্র তুলে নেওয়ার জন্য ইউক্রেনের সেনাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। সে কথায় কান না দিয়ে প্রতিরোধের অস্ত্র তুলে নিয়েছেন ইউক্রেনীয়রা।
ভিক্তর রুশ ভাষায় লিখেছে, ‘ভিয়েরু ভি পাবেইদু নাশিখ’; অর্থাৎ ‘আমাদের বিজয়ে আমি বিশ্বাসী।’
ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা বিস্ময়কর। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরা একযোগে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইউরোপের আকাশে রুশ বিমানের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছে। ফেডেক্স রাশিয়ায় ডাক বিতরণ স্থগিত করেছে। ফুটবল খেলোয়াড়েরা রুশ দলের সঙ্গে খেলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। নিউইয়র্কে পুতিনপন্থী হিসেবে পরিচিত অপেরা গায়কদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এমনকি রুশ ভোদকা বিক্রি করতে আপত্তি জানিয়েছেন কানাডার রেস্তোরাঁর মালিকেরা। সবচেয়ে বিস্ময়কর, খোদ রাশিয়ার ভেতরে প্রতিবাদ। পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অধিকাংশ বড় শহরে মিছিল হয়েছে, কয়েক হাজার মানুষকে টেনেহিঁচড়ে গ্রেপ্তার করার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
এই প্রতিক্রিয়া প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে এতটাই বিচলিত করেছে যে তিনি পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের জন্য প্রস্তুতি নিতে তাঁর সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। যুক্তি হিসেবে বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘অবৈধ নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করেছে এবং তারা অতি কঠোর ও আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলছে। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সামরিক সদস্যদের ‘সামরিক দায়িত্ব’-এর জন্য প্রস্তুত থাকার কথা বলেছেন তিনি।
জাতিসংঘের কাঠগড়ায় রাশিয়া
২৫ ফেব্রুয়ারি নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশনে ইউক্রেন আক্রমণের নিন্দা জানিয়ে যে খসড়া প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র উত্থাপন করেছিল, রাশিয়ার ভেটোর কারণে তা গৃহীত হয়নি। কিন্তু সে বিতর্কে স্পষ্ট হয়ে যায় রাশিয়ার পাশে কেউ নেই। সামরিক ও বাণিজ্যিকভাবে জড়িত তিনটি দেশ—চীন, ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এই প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে। অবশিষ্ট ১১টি দেশ নিন্দাসূচক প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। চলতি মাসে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে রাশিয়া। ইউক্রেন দাবি তুলেছিল, এই দায়িত্ব অন্য কেউ পালন করুক, রাশিয়া তাতে রাজি হয়নি।
নিরাপত্তা পরিষদ ইউক্রেন প্রশ্নে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় বিষয়টি সোম ও মঙ্গলবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আলোচিত হবে। এখানে স্মরণযোগ্য, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদ কোনো প্রস্তাব গ্রহণে ব্যর্থ হলে বিষয়টি একইভাবে সাধারণ পরিষদে পাঠানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে আহূত এই বৈঠকের পক্ষে ইতিমধ্যে ৮০টির বেশি দেশ সমর্থন জানিয়েছে। জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিন্ডা টমাস গ্রিনফিল্ড তাঁর রুশ প্রতিপক্ষের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বলেছেন, ‘আপনি আমাদের প্রস্তাবের বিপক্ষে ভেটো দিতে পারেন, কিন্তু আমাদের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করতে পারবেন না।’
সাধারণ পরিষদ এই প্রশ্নে যে প্রস্তাবই গ্রহণই করুক, সেটি হবে একটি সুপারিশমাত্র, তা বাস্তবায়নে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে বিপুলসংখ্যক দেশ যদি মস্কোর সামরিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ হিসেবে নিন্দাসূচক প্রস্তাব গ্রহণ করে, তা প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্য বিব্রতকর হতে পারে।
সবার চোখ চীন ও ভারতের দিকে
যুক্তরাষ্ট্র গত এক দশকের বেশি সময় ‘এশিয়ার প্রতি নজর’ নামের যে রণকৌশল অনুসরণ করছে, তাতে রাশিয়া নয়, চীনকেই সে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করছে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীন ও রাশিয়া তাদের পুরোনো আদর্শগত মতভেদ ভুলে নিকট সম্পর্ক নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছে। বেইজিংয়ে শীতকালীন অলিম্পিকের সময় প্রেসিডেন্ট পুতিন ও চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং একে অপরের হাতে হাত রেখে ‘অনিঃশেষ বন্ধুত্ব’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। জ্বালানিঘাটতির দেশ হিসেবে চীনের প্রধান আগ্রহ রাশিয়া থেকে প্রয়োজনীয় গ্যাস-তেল সংগ্রহ। রাশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে মঙ্গোলিয়া হয়ে তেল সংগ্রহের লক্ষ্যে ৪০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি পাইপলাইন নির্মাণে অর্থ বিনিয়োগ করছে। ইউরোপ যদি রুশ গ্যাস-তেল কেনায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে এই চুক্তি মস্কোর জন্য বিকল্প অর্থনৈতিক ‘লাইফ লাইন’ হিসেবে কাজ করবে। ডলারের বদলে চীনা ইউয়ানের মাধ্যমে বাণিজ্য সম্পাদনের ব্যাপারেও দুই দেশ সম্মত হয়েছে।
রাশিয়ার সঙ্গে এই নৈকট্যের কারণে ইউক্রেন প্রশ্নে চীনের ভূমিকা সবার কাছে আগ্রহের বিষয়। রাশিয়ার ওপর তার প্রভাব খাটানোর অনুরোধ জানিয়ে ওয়াশিংটন একাধিকবার যোগাযোগ করে বলে জানিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস, কিন্তু বেইজিং থেকে কোনো সদুত্তর আসেনি। উল্টো তারা যুদ্ধ নিয়ে মিথ্যা প্রচারের জন্য ওয়াশিংটনকে দোষারোপ করেছে।
নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে সমর্থন না জানালেও চীন এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার সরাসরি সমর্থন জানায়নি। সংকটের সমাধানে সে যে পাঁচ দফা প্রস্তাব রেখেছে তার মূল বক্তব্য, চীন ইউক্রেনসহ যেকোনো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘনের বিরোধী। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক মতামত উপেক্ষা করে পুতিনের পক্ষে খোলামেলা সাফাই গাওয়া চীনের পক্ষে সহজ হবে না। বাণিজ্য ও প্রযুক্তির কারণে চীন এখনো নানাভাবে পশ্চিমের মুখাপেক্ষী। মস্কোর সঙ্গে চীনের বাণিজ্যের পরিমাণ তার মোট বাণিজ্যের মাত্র ২ শতাংশ। ইসরায়েলি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জেরুজালেম পোস্ট পত্রিকা জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত চীন পশ্চিমা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এড়াতে লক্ষণীয় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। জানা গেছে, চীনের ভেতরে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের প্রতিবাদ হয়েছে। এটি তাৎপর্যপূর্ণ যে চীনা সামাজিক মাধ্যমে ওই প্রতিবাদের খবর প্রচারে কোনো আপত্তি করেনি বেইজিং।
অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে পুরোনো বন্ধুত্ব ছাড়াও ক্রমবর্ধমান সামরিক সহযোগিতার কারণে ভারতও ইউক্রেন প্রশ্নে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণে আগ্রহী হবে। চীনবিরোধী ‘কোয়াড’-এর সদস্য হিসেবে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত মৈত্রী সম্পর্ক আবদ্ধ হওয়ায় ওয়াশিংটন ইউক্রেন প্রশ্নে ভারতের সমর্থন আশা করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই প্রশ্নে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথাও বলেছেন, কিন্তু ভারত রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সমালোচনায় সম্মত হয়নি। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও তাঁর কথায়, ‘মোদিজির সমর্থন চেয়ে আবেদন’ করেছেন। চীনের মতো ভারতও কূটনৈতিক উপায়ে ও শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানের পরামর্শ দিয়েছে। ভারতের এই দোমনা মনোভাবের কারণ, রাশিয়ার ওপর তার সামরিক নির্ভরশীলতা। দেশটির অস্ত্র আমদানির অর্ধেকের বেশি আসে রাশিয়া থেকে। বিমানবিধ্বংসী মিসাইল প্রযুক্তি উদ্ভাবনেও ভারত রাশিয়ার মুখ চেয়ে আছে।
রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশেরও নিকট সম্পর্ক রয়েছে। একাত্তরে মস্কো বাংলাদেশের পাশে ছিল, স্বাধীনতার পরও সে সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। অনুমান করি, সাধারণ পরিষদে রাশিয়াকে নিন্দা করে প্রস্তাব উঠলে বাংলাদেশও ভারতের মতো নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করবে।