Showing posts with label জীবনের গল্প. Show all posts
Showing posts with label জীবনের গল্প. Show all posts

Saturday, January 11, 2020

প্রেমের গল্প: তুমি যাহা চাও


নিজেকে প্রাণপণে সংযত করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম কি? আমার মনের মধ্যে একধরনের হীনম্মন্যতার সৃষ্টি হলো, ভাবলাম আমি বুঝি তার যোগ্য নই, আধুনিক নই, মনের সঙ্গে বিবেকের লড়াই শুরু হয়ে গেল, বিবেক বলছে, কাউকে জোর করে আটকে রেখে কিছুই পাওয়া যায় না, আর মন বলছে, আমিও তো ভালোবাসি, আমারও ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার আছে। এই আত্মদ্বন্দ্বে আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হলো। আমি বুঝলাম, আমাকে পালাতে হবে, সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য আমাকে বসতে হবে নিজের মুখোমুখি। জানতে হবে কী চাই আমি, কে সত্য সেটা নয় বরং কোনটা সত্য, সেটাই জানতে হবে, তা যত কঠিন আর যত হৃদয় ভেঙে দেওয়ার মতো নির্মমই হোক না কেন!

বকুল প্রথমে কিছু বলতে না চাইলেও পরে আমার জেরার মুখে স্বীকার করেছে, স্পষ্ট করেই বলেছে, আমি বাড়িতে না থাকলে সে প্রায়ই গাজীপুরের ছায়া–বিথিতে পরাগের বাসায় যায়।

‘কী করো ওইখানে যেয়ে?’

রাগ, দুঃখ, ঈর্ষা আড়াল করে স্বাভাবিক কণ্ঠে জানতে চাইলে বকুল খানিকক্ষণ নীরব থেকে নিচু গলায় বলে,

‘কিছু না। বেশির ভাগ সময় চুপচাপ বসে থাকি। মাঝে মাঝে গল্প করি। পরাগ চাইলে নদীর পাশে, নয়তো শুধু অচেনা কোনো রাস্তা ধরে হাঁটি...’

‘কেন বকুল? কেন যাও ওর কাছে? কেন ওর সঙ্গে সম্পর্ক রাখো? আমার খারাপ লাগে, কষ্ট হয়, বোঝো না তুমি? মনে হয়, তুমি বিশ্বাস ভেঙেছ, প্রতারণা করছ আমার সঙ্গে, আমি মানতে পারি না, কত দিন বলেছি তোমাকে, যেয়ো না...’

বকুল কথা বলে না। মাথা নিচু করে থাকে, হাতের আঙুলে ওড়না পেঁচায়। তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি ঝরে পড়ে। বকুলের নিরাভরণ সৌন্দর্যে আবার মুগ্ধ হই আমি, মানুষের কান্নাও এত সুন্দর হয়? দুহাতে ওর কান্নাভেজা উষ্ণ সরল মুখটা তুলে ধরি, ঘরের ভেতর ঝরা বকুলের স্নিগ্ধ সুবাস ছড়িয়ে পড়ে, ব্যাকুল হয়ে বলি, ‘আমাকে ভালোবাসো না তুমি? পরাগকে ভালোবাসো? তাহলে ওকে বিয়ে করলে না কেন, বলো, কেন আমার সঙ্গে জড়ালে?’

‘পরাগ আমার বন্ধু। অন্য কিছু নয়, বলেছি তো তোমাকে, তা ছাড়া...’। বকুল কথা না শেষ করেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। নিজেকে হঠাৎ খুব অসহায় আর অস্থির লাগে আমার।

‘ওফ! বকুল! আমি যদি একা একা কোনো মেয়ের বাসায় যাই, তার সঙ্গে হাঁটি, ঘুরে বেড়াই, আর বলি ও আমার বন্ধু, তোমার কেমন লাগবে বলো তো! পারবে সহজভাবে মেনে নিতে? তোমার কি নিজেকে প্রতারিত মনে হবে না?’

বকুলের ঠোঁট কাঁপে, হয়তো কিছু বলার জন্য, কিন্তু কিছুই বলে না সে, আমার প্রশ্নেরও কোনো উত্তর দেয় না। থাক এই মুহূর্তে উত্তর চাই না আমি। ওকে বরং সময় দিই, একা একা ভাবার সুযোগ দিই। ভাবুক, ওর জায়গায় আমাকে কল্পনা করে ভাবতে থাকুক। দেখি কী প্রতিক্রিয়া হয় ওর!

পাশের ঘরে এসে সিগারেট ধরাই, পায়চারি করি। আমি কি তবে নিজের অজান্তেই বকুলের আত্মাকে খাঁচায় বন্দী করেছি? দখল করেছি তাকে? নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছি? তাকে নিজের কেনা সম্পত্তি ভাবছি? বকুলকে দোষী করে নিজে জিততে চাইছি? আর বকুল? ওই বা কী চাইছে? পরাগের সঙ্গে এসব কি কেবল নির্দোষ ভাববিনিময়? নাকি ওর নিঃসঙ্গতা ঘোচানোর নিষ্পাপ চেষ্টা? আমি কি খুব নিষ্ঠুর আচরণ করেছি ওর সঙ্গে? বুঝতে পারি না। ইচ্ছা করে, জগতের সবাইকে শুনিয়ে চিৎকার করে কাঁদি। ইচ্ছা করে, জনে জনে ডেকে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা বলি। জিজ্ঞেস করি, এমনটা কি আমার প্রাপ্য ছিল? গভীর এক হতাশা, ক্ষোভ আর সীমাহীন বেদনা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এ রকম মনোভাবের সময়ই কি মানুষ তার সবচেয়ে প্রিয়জনকে নিজ হাতে হত্যা করার মতো ভয়ানক সিদ্ধান্ত নেয়? আমিও কি নিজের শিক্ষা-সংস্কৃতি-নীতি-নৈতিকতা বোধ সব ভুলে গিয়ে তেমন ভয়ংকর কিছু করে ফেলব? মনের এই প্রচণ্ড অশান্তি, এই গোপন তাণ্ডব সামাল দিতে গিয়ে বুকের ভেতর একটা অজানা চাপ অনুভব করলাম আমি, তলিয়ে গেলাম শূন্যতার অতল গহ্বরে, তারপর সেখান থেকে সমস্ত শক্তি দিয়ে আবার নিজেকে টেনে তুললাম। আর বুকে পাথর বেঁধে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার যা হয় হোক, হৃদয় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাক, জীবন এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকুক, কিন্তু বকুল যা চাইবে, তাই হবে, আমি যত দুঃখই পাই না কেন। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব সহজ ছিল না, কিন্তু এ ছাড়া আর কীই-বা করার ছিল আমার!

তিন কামরার ছোট্ট বাসার গুমোট নিস্তব্ধতা ভাঙতে গলা উঁচু করে বকুলকে শুনিয়ে বললাম, ‘এক কাপ চা হবে নাকি?’

বকুল এলাচি-দারুচিনি দিয়ে আমার পছন্দের মাসালা চা নিয়ে এলে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলি, ‘পরাগকে একদিন বাসায় ডাকো, চা খেতে খেতে আলাপ করি।’

(আমার প্রতিপক্ষের ধূর্ত চেহারাটা দেখি, তার ব্যক্তিত্ব মাপি, শক্তি আর দুর্বলতা যাচাই করি। দেখি কী জাদু আছে ওর মধ্যে, যা আমার মধ্যে নেই। নিজেকে ওর পাশে দাঁড় করিয়ে দেখি আমরা ঘাটতিটা কোথায়?)

বকুল চমকে উঠে ভীরু হরিণীর মতো চকিত চোখে আমার দিকে তাকায়। ‘কেন?’

‘বাহ্ তোমার বন্ধু তো আমারও বন্ধু, সেই বন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হব না? অসুবিধা আছে?’

বকুল অস্ফুট কণ্ঠে বলে, ‘পরাগ কখনোই এখানে আসতে পারবে না।’

ক্রুদ্ধ উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠি আমি, ‘কেন আসতে পারবে না? আসার সাহস নেই বলে, তাই না? ভীরু, কাপুরুষ একটা! আমার মুখোমুখি হতে ভয় পায়? সম্পর্কের দায়িত্ব নিতে ভয় পায়? ডাকো ওকে, বলো তোমাকে নিয়ে যেতে, আমার কোনো আপত্তি নেই। তুমি মুক্ত, যখন ইচ্ছা ওর সঙ্গে চলে যেতে পারো! আমার আর কিচ্ছু বলার নেই।’

একতরফা রায় ঘোষণা করে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না আমি, হাতে ধরা চা–ভর্তি কাপটা একঝটকায় মেঝেতে ছুড়ে ফেললাম। ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গেল কাপটা, চা ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। যেন চায়ের কাপ নয়, আমার সমস্ত অস্তিত্ব, আমার বিশ্বাস, ভরসা আর এত দিনের ভালোবাসা একমুহূর্তে ভেঙে পড়ল। বকুল নিচু হয়ে বসে কাপের ভাঙা টুকরোগুলো একসঙ্গে জড়ো করল। ঘর মোছার কাপড় এনে মেঝেতে পড়ে থাকা চা মুছল। তারপর ভাঙা কাপের টুকরোগুলো একটার সঙ্গে আরেকটাকে লাগিয়ে নিয়ে বিষণ্ন গলায় নিজের মনেই বলল, ‘কী সুন্দর ছিল কাপটা, আর কি জোড়া লাগবে?’

আমি ততক্ষণে ঝড় থেমে যাওয়ার পরের আকাশের মতো শান্ত আর নিশ্চুপ। মাথায় এলোপাতাড়ি কত রকমের চিন্তা আসছে, মনে হচ্ছে যেন একটা প্রচণ্ড ঘূর্ণির তাণ্ডবে সব এলোমেলো হয়ে গেছে। নিজেকে মনে হচ্ছে একটা ধু ধু বালুচর, তৃণহীন, বৃক্ষহীন বিরান ভূমি। বকুল আর আমার মাত্র ছয় মাসের সংসার, এখনো একজন আরেকজনকে ভালোভাবে চিনেই উঠতে পারিনি, আর এরই মধ্যে মিছে হয়ে গেল সব। সব খেলা সাঙ্গ হলো! এ কেমন খেলা? এ কেমন লীলা? বুঝি না। নিজেকে সান্ত্বনা দিই, যা হয়েছে তা ভালোই হয়েছে, যা হচ্ছে তা ভালোই হচ্ছে, যা হবে তা-ও ভালোই হবে। তারপরও বোকার মতো আমি কেন কাঁদছি? কেন নিজেকে এমন সব হারানো মানুষের মতো শূন্য, দীনহীন মনে হচ্ছে? আমি ঠিক করেছি, নিজে গিয়ে সব দাবি ছেড়ে বকুলকে পরাগের বাড়িতে দিয়ে আসব, বকুলের ভালোর জন্য যা যা করা দরকার, তার সব করব।

‘না। ধন্যবাদ। আমার কিসে ভালো, কিসে মন্দ, সেটা না হয় আমাকেই বুঝতে দাও।’

আমি গাড়ি দিয়ে তাকে পৌঁছে দিতে চাইলে শান্ত গলায় বলল বকুল।

আমাকে পেছনে ফেলে বেরিয়ে গেল একাই, যেন ডানা ঝাপটে চোখের সামনে দিয়ে উড়ে চলে গেল একটা সাদা পাখি। নিজেকে মনে হলো স্বনির্মিত কারাগারে বন্দী হয়ে থাকা এক বিধ্বস্ত কয়েদি। কতক্ষণ ছটফট করলাম। বোতল খুলে ব্যাপক মদ্যপান করলাম সিনেমার বিরহী নায়কের মতো, মড়ার মতো পড়ে রইলাম। প্রিয় গানগুলো শোনার চেষ্টা করলাম। নিজের ভেতরের যন্ত্রণার আগুন নিভল না কিছুতেই, বরং দ্বিগুণ পোড়াতে শুরু করল, শুতে পারলাম না সুস্থির হয়ে, ঘুমাতে পারলাম না একটুও, কিছুতেই সামান্যতম শান্তি না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ভোরবেলা গাড়ি নিয়ে বের হলাম, উদ্দেশ্যহীন চালাচ্ছি, অনির্দিষ্ট ঠিকানায়, চালাতে চালাতে দেখি আমি কখন যেন উঠে পড়েছি গাজীপুরের রাস্তায়। হ্যাঁ, ছায়া-বিথিতেই যাচ্ছি আমি, যেখানে বকুল যেত সেই পরাগের বাড়িতে।

ছোট্ট জায়গা, একে ওকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চয়ই বাড়িটা খুঁজে পাব। সরু গলি, ছোট ছোট দোতলা, তিনতলা বাড়ি, টিনের সেমিপাকা ঘর, ঝাঁকড়া আমগাছ, টং দোকান, নির্জন মাঠ, ডোবা পেরিয়ে গেলাম। সূর্য চনচন করে আলো ছড়ালে রাস্তার পাশে একটা বাঁশের ঝাঁপ দেওয়া চা দোকানের সামনে গাড়ি থামাই, কাঠের নড়বড়ে বেঞ্চে বসে গরুর দুধ দিয়ে বানানো মালাই চা খাই। একটা তিন-চার বছর বয়সী বাচ্চা এসেছে গোল টুপি মাথায় দিয়ে, বাবার সঙ্গে, চুকচুক করে চুমুক দিয়ে দুধ–চা খাচ্ছে। বাবা খুশি খুশি গলায় গল্প করছে পাশের জনের সঙ্গে, ‘এই চা না খাইলে তার চলেই না। ছয় মাস ধইরা পরতেক দিন সকালবেলা অরে এই চায়ের দোকানে নিয়া আসতে হয়।’

আমি চা-পিয়াসী ছোট্ট ছেলেটাকে দেখি, গোলগাল চেহারা, কোমল ত্বক, লাজুক মুখ আর জ্বলজ্বলে দুটি চোখ। আমার তখন মনে পড়ে, এই এলাকায় আমি পরাগের বাড়ি খুঁজতে এসেছি। চায়ের দোকানদারকে জিজ্ঞেস করি, চা–পানরত, দোকানে আড্ডারত, পথে হেঁটে যাওয়া মানুষজনের কাছে জানতে চাই কেউ পরাগকে চেনেন কি না, পরাগের বাড়ি চেনেন কি না? লোকজন মাথা নাড়ে, বয়স্করা পাল্টা জিজ্ঞেস করে, ‘উত্তর ছায়া-বিথি, না দক্ষিণ ছায়া-বিথি? পূর্বপাড়া না পশ্চিমপাড়া? উনার বাপের নাম কী বলেন? কত দিন ধরে এই এলাকায় থাকে? ছাত্র না কর্মজীবী? চাকরি করে না ব্যবসা? নিজের বাড়ি না ভাড়াটিয়া?’

মানুষের এত প্রশ্ন কেন? কেন তারা তাকায় আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে? কেন তারা হাসে, বলে ভালো করে ঠিকানা জেনে নিয়ে আসেন। আমার তখন প্রচণ্ড রোখ চেপে যায়, পরাগের বাড়ি খুঁজে বের করতেই হবে। আমি প্রতিটি বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ি, এটা কি পরাগের বাড়ি? আপনারা কি চেনেন পরাগকে? ছায়া-বিথিতে নয় যেন আমি চক্রাকারে ঘুরছি কোনো অচিন গহ্বরে। ঘুমাতে ঘুমাতে হাঁটছি, ঢুলছি, হাঁটতে হাঁটতে ঘুমাচ্ছি। এই পৃথিবীতে কোথাও কি সে নেই? এই পথে, এই ঘাসে, এই সব কোলাহলে ভরা ছায়া-বিথির বাড়িগুলোতে কেউ কি চেনে না পরাগকে?

‘পরাগ? কোন পরাগের কথা বলছ তুমি, বাবা?’

একটা আধভাঙা প্রাচীরঘেরা পুরোনো বাড়ির শ্যাওলা পড়া উঠানে দাঁড়িয়ে সাদা চুলের এক থুত্থুড়ে বুড়ি জিজ্ঞেস করে আমাকে, ততক্ষণে সন্ধ্যার অন্ধকার ঝুঁকে এসেছে লম্বা নিমগাছের মাথায়। আমি তার কাছাকাছি এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলি, ‘বকুলের বন্ধু পরাগের কথা বলছি আমি, তার বাড়িটা খুঁজছি, বুড়িমা।’

বুড়ি লাঠিতে ঠুকঠুক শব্দ তুলে কাঠের ভারী দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে যায়। তারপর আবার ফিরে আসে, হাতে একটা সাদা–কালো ফটোগ্রাফ। ঝাপসা হয়ে গেছে ছবিটা। অস্পষ্ট বোঝা যায় এক তরুণের ফ্যাকাশে রুগ্​ণ মুখ, মাথায় লতিয়ে থাকা কালো চুল আর তার দুটি করুণ সুন্দর চোখ।

‘এই তো পরাগ।’ বুড়ি বলে, ‘এই পথ ধরে যাও, শিমুলগাছের তলে গভীর অন্ধকারে পরাগের বাড়ি, ওইখানে এক বছর ধরে, একা একা শুয়ে আছে সে। বকুলের বন্ধু পরাগ।’

Saturday, January 4, 2020

প্রেমের গল্প: চেনা লোক অচেনা লোক



কে হ্যাঁয় আজ হাম তুম নাহি
গ্যায়ের কোয়ি...

লোকটা অনেকক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে একটা বাড়ির গেটের সামনে। গেটটা কাঁধসমান উঁচু, ওপরে মধুমালতীর ঝাড়, এখন ফুল নেই কোনো, বরং রাস্তার ধুলায় পাতাগুলো ধূসরিত। সে হয়তো এই সন্ধ্যার আলো নিভে যাওয়া সময়ে বুঝতে পারত না পাতাগুলো তাদের স্বাভাবিক রং হারিয়েছে। পারছে, কারণ তিথি আপার বাসায় যাওয়ার সময়ও এই গেটটাকে দেখেছে সে এবং এই লোকটাকেও, এখানেই।

এমন কি হতে পারে যে এখানেই লোকটার বাসা, সে এই বাড়ির মেজ ছেলে, বাড়িতে সে আর তার বুড়ো মা ছাড়া কেউ থাকে না, বাকি ভাইবোনেরা বিদেশে থাকে, কিংবা অন্য জেলায়, ঢাকা বা চিটাগং। কিন্তু বাইরে থাকা বড়লোকদের বাড়িগুলো আরও সুসজ্জিত থাকে, রাস্তার পাশে হলে পাঁচিল উঁচু করা হয়, নিয়মিত রং করা হয়। এই বাড়িটাকে দেখে মনে হয় না কোনো যত্নের ছাপ আছে। আর লোকটাও তেমনি, একটা হাইনেকের সোয়েটার গায়ে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, না কামানোর জন্য নাকি এটাই তার স্টাইল—তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।

সে খানিক দাঁড়ায়, রাস্তার উল্টো পাশ দিয়ে যেতে যেতে থামে, লোকটাকে ভালো করে দেখে। বাসায় ফেরার তাড়া নেই তার। সাজিদ অফিসের কাজে বাইরে গেছে কয়েক দিন আগে, আজও ফিরবে না। রান্নার ঝামেলা নেই, একা থাকলে সে নুডলস দিয়ে ডিনার সেরে নিতে পারে। প্রথম দুবেলা সে তা-ই করেছে, দ্বিতীয় রাত থেকে কিছু আর খায়নি। এখন প্রচণ্ডই খিদে পেয়ে গেছে, এতক্ষণ টের পাচ্ছিল না যদিও।

সামনে দিয়ে হুস করে একটা ময়লার গাড়ি চলে গেল। সে জায়গা থেকে নড়ে না। লোকটাও প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ডান দিকে তাকিয়ে, ভুরু কুঁচকে। কারও জন্য কি অপেক্ষা করছে? না এমনিতেই, কোনো কাজ নেই বলে?

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হয়, অনেক সময় চলে গেছে; হয়তো এভাবে অনেক দিন ধরেই সে এখানে দাঁড়ানো—এমন অদ্ভুত অনুভূতি হওয়ার কোনো কারণ সে বুঝে পায় না। সে কি তাহলে এই লোকটার জন্য অপেক্ষা করছে? লোকটা তার দিকে একবার তাকালেই সে চলে যেতে পারে, মুক্ত হতে পারে?

রাস্তা পার হয়ে সে মধুমালতীর ঝাড়ওয়ালা গেটের দিকে এগোয়। লোকটা এখনো তাকে দেখেনি। নিজেকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার সময় পাওয়া গেল, ভালোই হলো বেশ।

‘এক্সকিউজ মি’ বলবে কি না, ভাবতে ভাবতেই ঘুরে বাঁ দিকে তাকায় হাইনেক সোয়েটার আর খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা লোক, বছর পঁয়তিরিশেক হবে বয়স, বেশিও হতে পারে। চেহারাটার যত্ন নিলে হয়তো আরও কম দেখাত।

‘আমি কি আপনাকে চিনি?’ বেমক্কা এই প্রশ্নে লোকটার বিরক্ত হওয়ার কথা ছিল, অন্তত তার চেহারা দেখে মনে হয়েছে যে সে অযথাই বিরক্ত হতে পছন্দ করে; কিন্তু হেসে ফেলে সে।

‘আমি কীভাবে বলব?’

‘না, মানে, আপনি কি আমাকে আগে দেখছেন কোথাও?’

‘মনে পড়তেছে না তো।’

‘আমার আপনাকে চেনা চেনা লাগতেছে তো, সেই জন্যই জিজ্ঞেস করলাম।’

লোকটা আবার হেসে ফেলে। তার হাসিটা বেশ উজ্জ্বল, একেবারেই তার জামাকাপড় আর চেহারার মতন মলিন নয়।

এবার সে-ও হাসে, হেসে বলে, ‘আপনি কি ব্যস্ত?’

‘না তো।’

‘তাহলে চলেন চা খাই।’

হয়তো এবার লোকটা সন্দেহ করতে পারে, বিরক্ত না হলেও। যদিও তাকে দেখে সন্দেহ করার মতন কিছু নেই। একটা সাধারণ শাড়ির ওপর সুতির চাদর পরা, কাঁধে বড় একটা ব্যাগ, ব্যাগে তিথি আপার দেওয়া খাবারের বাক্স। বাক্সে কমলালেবু দিয়ে রান্না করা চিনিগুঁড়া চালের জর্দা। জর্দার কথাটা মনে পড়তেই তার আবার খিদে পেয়ে যায়।

যেতে যেতে একলা পথে
নিভেছে মোর বাতি...

‘চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবেন?’ এমন ভঙ্গিতে প্রশ্নটা করল যেন তাকে কত দিন ধরে চেনে এই লোক।

‘শিঙাড়া খাব, আমার খুব খিদা পাইছে।’

‘আপনারে দেইখাই মনে হইছিল।’ সবজান্তার ভঙ্গিতে কথাটা বলে শিঙাড়া অর্ডার করে, আসার সময় হাতে একটা সিগারেট নিয়ে আসে, ‘স্মোক করলে সমস্যা হবে?’

‘নাহ্। আমার হাজবেন্ড অনেক স্মোক করে, অভ্যাস হয়ে গেছে।’

‘কী করেন আপনার হাজবেন্ড?’ সিগারেট ধরাতে ধরাতে যেন ভদ্রতা করেই প্রশ্নটা করল, জানার আগ্রহ তেমন নেই, থাকার কথাও না হয়তো।

‘আমার বোনের সঙ্গে প্রেম করে।’

সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে আবারও সুন্দর করে হাসে লোকটা, বাচ্চাদের পাকা কথা শুনে কিন্ডারগার্টেনের ভালো মিসরা যেমন হাসে।

‘আপন বোন না, মামাতো বোন।’

‘বড় না ছোট?’

‘অনেক বড়, আমার চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড় হবে।’

তিথি আপার বয়স কি আসলেই অত বেশি? দেখে মনে হয় না। আজও বাসায় একটা ছেলেদের হুডওয়ালা পুলওভার আর ফ্লানেলের পাজামা পরে ছিল, দেখে মনে হচ্ছিল সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোনো যুবতী। কে বলবে তার দশ বছর আগে বিয়ে হয়েছে আর বাচ্চাও আছে দুইটা?

‘নেন, শিঙাড়া খান।’

‘আপনি এইটা খান,’ ব্যাগ থেকে প্লাস্টিকের বাক্স বের করে এগিয়ে দেয় সে।

‘কী এইটা?’

‘আমার বোনের বানানো জর্দা, খুব ভালো রান্না করেন উনি।’

‘আপনি কেমন রান্না করেন?’ জর্দার বাক্স নেওয়ার কোনো আগ্রহ দেখা যায় না।

‘আমিও ভালো রান্না করি।’ কথাটা সত্যি। তার রান্না খেয়ে কেউ কখনো খারাপ বলেনি, সাজিদ তো বলেইনি।

‘তাইলে আপনের জামাই ওনার সঙ্গে প্রেম করবে কেন?’

‘ছেলেরা কি রান্নার জন্য প্রেম করে?’ শিঙাড়া মুখে থাকাতে প্রশ্নটা করতে দেরি হয়ে যায় তার।

‘তাইলে কী জন্য করে?’ লোকটা খুব মজা পাচ্ছে, অপরিচিত এক মেয়ে যেচে কথা বলে আবার নিজের স্বামীর পরকীয়ার গল্প করলে তাকে পাগল ভেবে নিয়ে বিনোদন নেওয়া দোষের কিছু নয়।

‘আপনিই বলেন।’

সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে লোকটা বলে, ‘আপনি গান জানেন?’

‘না তো।’

‘আপনেরে দেইখা মনে হয় জানেন, রবীন্দ্রসংগীত।’

‘তাই নাকি? আর কী মনে হয়?’

লোকটা উত্তর দেয় না, দোকানের ছেলেটার কাছে আরেকটা সিগারেট চায়, আর গুনগুন করে গান ধরে, ‘তুমহে দিল্লাগি ভুল যানি পারেগি, মুহাব্বাত কি রাহো মে আ কার তো দেখো...’

হঠাৎ করেই টিমটিমে ফিলামেন্ট বাতিটা নিভে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। দোকানটা অন্যান্য দোকান থেকে একটু দূরে। ইচ্ছা করেই এখানে এসেছে তারা, ভিড় কম বলে। অন্য দোকানগুলোর ক্যাটক্যাটে সিএফএল বাতিগুলোও নিভে গেছে। লোড শেডিং।

ডোন্ট ইউ লাভ হার অ্যাজ শি’জ
ওয়াকিং আউট দ্য ডোর? লাইক শি ডিড ওয়ান থাউজ্যান্ড টাইমস বিফোর?

‘দ্যান তো ওইটা, কী জানি খাইতে দিতে চাইছিলেন।’

সে সামনে রাখা বাক্সটা এগিয়ে দেয়। একটা টেবিল তারা দখল করে বসেছে বলে দোকানদারের কোনো দুশ্চিন্তা নেই, এখন পর্যন্ত চার কাপ চা আর তিনটা সিগারেট বিক্রি হয়েছে তার।

দোকানদারের কাছ থেকে চামচ চেয়ে নিয়ে জর্দা মুখে দেওয়ার আগে তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় লোকটা।

‘আমি খাব না।’

‘কেন খাবেন না? রাগ কইরা? খাওয়ার উপ্রে রাগ করতে নাই।’

তার হঠাৎ চোখে পানি এসে যায়। মা এভাবে বলতেন, ‘খাওয়া হইলো আল্লাহর নিয়ামত, কিসমতে যা জুটছে, তা খাইতে হয়, নাইলে নাফরমানি হয়।’ আম্মা মারা যাওয়ার পর আর কেউ খাবার নিয়ে সাধাসাধি করেনি। ভাগ্যিস বিদ্যুৎ আসেনি, লোকটা দেখতে পাবে না সে কাঁদছে। আর দেখলেই কী? এত কিছু বলে ফেলেছে যখন।

‘ঘি একটু কম হইছে, মিষ্টিও; নেন, খায়া দেখেন।’

নিজেকে সামলে সে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, আপনি কি বাঙালি?’

‘আমারে দেইখা কি ইংরেজ মনে হয়?’ আবার হাসতে থাকে লোকটা। অথচ মধুমালতীর ঝাড়ওয়ালা গেটের সামনে দাঁড়ানোর সময় তাকে বেশ খিটখিটে মেজাজের বদরাগী লোক বলে মনে হচ্ছিল।

‘না, বিহারি মনে হয়।’

এবারে হো হো করে হেসে ফেলে লোকটা। তার হাসির আওয়াজে দোকানদার পেছন ফিরে তাকায়, তার মুখটাও হাসি হাসি।

হাসিতে যোগ না দিয়ে সে তার আটকে রাখা কান্নাটা ছেড়ে দেয়। প্রসঙ্গ পাল্টে সে মায়ের কথা ভুলে যেতে চাইছিল। আহা রে মা, ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রিত থাকা বিধবা মা, ভাইঝিদের ঝি-গিরি করে মেয়ে মানুষ করা মা, আল্লাহভক্ত মা, মানুষে বিশ্বাস রাখা মা। ভালোই হয়েছে, মা নেই, বেঁচে থাকলে কত কষ্ট পেতেন, যখন দেখতেন তাঁর বাপের মতন বড় ভাই, যার মুখের ওপর কোনো কথা কেউ বলতে পারেনি, সেই ভাইয়েরই বড় মেয়ে নিজের প্রেমিকের সঙ্গে তাঁর মেয়ের বিয়ে দিয়ে যেন ফুফাতো বোনের কত বড় উপকার করল—এমন ভঙ্গিতে পরিবারের সবার পিঠ চাপড়ানি নিচ্ছে কতগুলো বছর ধরে, আর সব প্রমাণ নিয়ে গিয়েও তার মুখের ওপর কিছুই বলতে না পেরে তার রান্না খাবার বাক্সে করে নিয়ে এসেছে সেই মেয়ে...ছোট মেয়ে, পরিবারের সবচেয়ে ছোট, সবার ফরমাশ খাটার মতন ছোট, তিথির পুরোনো জামা পরে বড় হয়েছে বলেই কি তিথির পুরোনো প্রেমিকের সঙ্গেই সংসার করতে হবে তাকে? পুরোনোই-বা বলে কী করে? তাদের প্রেম তো এখনো চলছে। অথচ দুলাভাইয়ের সঙ্গেও প্রেমের বিয়েই তিথি আপার...

‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’

‘করেন’ একটু পর বাসায় গেলেই সব শেষ, সেসব ঠিক করে রেখে এসেছে। বাসার সামনের স্টোরে চার শ টাকা বাকি ছিল, চুকিয়েছে, তিনতলার ভাবি তার বাবার মৃত্যুবার্ষিকীর তেহারি পাঠিয়েছিলেন বড় বাটিতে, খালি খালি ফেরত দেওয়া ভালো দেখায় না আর অত বড় বাটিতে কী দেবে ভেবে পাচ্ছিল না বলে রয়ে গিয়েছিল বাটিটা, ফেরত দিয়েছে সেটা। বাকি ছিল তিথি আপার সঙ্গে দেখা করা, সেটাও করে এসেছে, যদিও কাজ হয়নি, জিজ্ঞেস করতে পারেনি কেন সে এমন করল, কী ক্ষতি করেছিল সে যে এমন প্রতারণা করতে হলো তিথির...আর সাজিদকে তো আগে চিনত না সে, ক্ষতি করার প্রশ্নই নেই।

‘আপনি কেমনে জানলেন ব্যাপারটা?’

সে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে অন করে। অন্ধকারে সামান্য আলো যেটুকু বের হয়, তাতে তেমন কিছুই দেখা যায় না, সাজিদের ভুলে ফেলে যাওয়া ফোন। চ্যাটবক্স মুছে রাখেনি, এমনকি কোনো পাসওয়ার্ড পর্যন্ত নেই। এতটাই বেপরোয়া...

এখানে ইন্টারনেট নেই, মেসেজবক্সের এসএমএসগুলো খোলে সে। বুঝতে পারে তার হাত কাঁপছে।

‘এটা আপনার জামাইয়ের ফোন?’

‘হুম,’ এগিয়ে ধরে সে, লোকটা পিছিয়ে যায় যেন একটু।

‘না, না, আমারে দেখানোর দরকার নাই, আমি ভাবতেছিলাম আপনি কোনো কারণে ওনারে ভুল বুঝতেছেন কি না।’

‘ভুল বুঝছিলাম, আগে, এখন ঠিকটা বুঝলাম।’

‘উনি কই?’

‘কে? আমার হাজবেন্ড?’

‘জি।’

‘অফিসের কাজে গেছে, বাইরে—বিদেশ।’

‘আপনে তাইলে বাসায় একাই?’

‘হ্যাঁ।’

‘একা থাইকেন না, মায়ের বাড়ি থাইকা আসেন কিছুদিন।’

‘আমার মা নাই।’ মায়ের বাড়িও তো আসলে তিথিদেরই বাড়ি। উঠে দাঁড়ায় সে।

‘আসি, অনেক ধন্যবাদ।’

কহিব তারে আমার প্রিয়ারে আমারও অধিক ভালোবাসিয়ো...

বাসায় ঢুকে সাজিদের ফোনটা আবার অন করে সে। ওয়াই-ফাই নিজে থেকে কানেক্ট হয়ে চ্যাটবক্স নোটিফিকেশন দিতে থাকে। সে একবার খুলে দেখতে চেয়েও দেখে না। তিন দিনে তারা নিশ্চয়ই যোগাযোগবিচ্ছিন্ন অবস্থায় নেই, তিথি হয়তো জানে ফোনটা তার কাছে, যদিও আজ সারা বিকেলে তার কোনো আচরণেই বোঝা যায়নি সে কথা। খুব স্বাভাবিক, খুব সব সময়ের মতন বাচ্চা নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিউটি পারলারে যাওয়ার উপদেশ দিয়ে বাক্সে জর্দা ভরে দিল।

ছোট একটা ব্যাগে দুয়েকটা কাপড়, টুথব্রাশ, চিরুনি আর টুকিটাকি ভরা ছিল। হ্যান্ডব্যাগের ভেতরের ছোট পার্সে রাখা ট্রেনের টিকিটটা ঠিকমতো আছে কি না, দেখে নিয়ে জর্দার বাক্সটা সিঙ্কে রেখে বাসায় তালা আটকায় সে, একবার ভাবে ধুয়ে রেখে যাবে। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টায়।

স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একটা বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করে সে। একবার ভাবে, সেই লোকটার ফোন নম্বর থাকলে বেশ হতো, তাকে স্টেশনে আসতে বলা যেত। কেউ বিদায় দিতে না এলে যাত্রাটা কেমন যেন লাগে। পরক্ষণেই মনে হয়, কোন অধিকারেই-বা আসতে বলত তাকে, চেনে না জানে না, অপরিচিত একটা মানুষ। কিন্তু চেনে বলে ভাবত, ভালোবাসাবাসির উদ্দাম রাতগুলোতেও কোনো দিন সন্দেহ হয়নি এই লোকটার মন পড়ে থাকতে পারে অন্য কোথাও।

সে ঠিক করে, এখন থেকে আর সে সাজিদের কথা ভাববেই না। চলে আসার আগে কোনো নোট লিখেও আসেনি সে। কীই-বা লিখত? শুভকামনা? ভালো থাকার আশীর্বাদ? সে কথাও কি আর লিখে জানাতে হবে? যা এত দিন এক ছাদের নিচে থেকে বুঝতে পারেনি সাজিদ, লিখলেই কি পারত?

আধো অন্ধকারে কেউ একজন এগিয়ে আসছে তার দিকে, চোখের কোনা দিয়ে সে দেখেছে। তাকায় না ভালোমতো, চেনা কেউ কি না, সেই লোকটা কি না...অথবা সাজিদই কি না, দেখতেও চায় না সে। একমনে রেললাইনের দিকেই তাকিয়ে থাকে।

Friday, January 3, 2020

গল্প : নীলচে দিন


শুক্রবারের সকাল হতে হতে যে খবরটা পাওয়া গেল, তা হলো ঝুমুর নেই—হাওয়া ।

ছুটির দিনে এমন বীভৎস খবর শুনতে কারোরই ভালো লাগার কথা না। একে শীতের আমেজ, তার ওপর এমন সংবাদ, আমার মনে হলো আজ উঠে আর কাজ নেই। পর্দার ওপার থেকে কমলা রোদ এসে পড়ছে ঘরের ভেতর, সেখানে একটা ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ। তীর্থ এখন এ ঘোড়ায় আর চাপে না। মাঝেমধ্যে শুধু টেনেটুনে এখানে–ওখানে রাখে। তীর্থর কণ্ঠ বাইরে, তার মায়ের সঙ্গে। বলছে, জুমু কই, জুমু?

ঝুমুরকে তীর্থ জুমু বলত। ওর মা বুয়া বলে ডাকত। আমি কিছু বলতাম না। বুয়া বলার জন্য ঝুমুরের বয়স কম ছিল। সতেরো–আঠারোর কাউকে বুয়া বলতে কেমন যেন বাধে!

রুনার কণ্ঠ, ল্যাপটপ আছে, বুঝেছ, নিয়ে যায় নাই!

আমার কিছু বলতে ইচ্ছা করছিল না। তবু বললাম, তা–ও ভালো।

রুনার কণ্ঠ, ভালো আবার কী? কী কী নিয়ে গেছে, এখনো কি জানি নাকি?

আমার এবার বলতে ইচ্ছা করল, খুঁজে দেখো। কিন্তু বললাম না। তীর্থ বাইরে থেকে বলল, বাবা, জুমু নাই গা!

ঝুমুর কাজে-টাজে ভালো ছিল। মাস ছয়েক আগে এসেছিল। ওর এক চাচি বা এমন কেউ নিয়ে এসেছিল। বলেছিল, আপনাদের বাড়িতেই রাখতেছি। দুজন মানুষ আপনারা…কাজকাম কম!

রুনা বলেছিল, না না কাজ অনেক। তীর্থ ছোট না, এর কাজ আছে মেলা। দরকার নাই।

আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম রুনার কথা। ঠিকঠাক একটা কাজের মেয়ে পাচ্ছে না বলে রুনার শতেক অনুযোগ। ছুটা বুয়াটা কাজে খুব ফাঁকি দেয় বলে প্রায় প্রতিদিন এসএমএস করে যখন অফিসে থাকি…আর এখন কিনা মেয়েটাকে বিদায় করে দিতে চাচ্ছে!

কিন্তু চাইলেই আর পারে কই! রেখে দেয়। বাধ্যই হয়। কাজ তো কম না। তীর্থ যেভাবে ঘর অগোছালো করে, সেসব ঠিকঠাক করে রাখতেই অন্তত একজন লাগে। ঘরের অন্য কাজ তো আছেই! রাতে রুনাকে বলি, মেয়েটাকে রেখে ভালো করেছ!

রুনা তাকায় আমার দিকে। তারপর একটা শ্বাস ফেলে বলে, তোমার তো ভালো লাগবেই!

এ কথার মানে খুঁজে পাই না। তীর্থ বলে, বাবা, মোবাইল!

মোবাইল নিয়ে এটা-সেটা বের করতে থাকে তীর্থ। রুনাকে বলি, তোমার কাজে হেল্প করতে পারবে বলেই বলছিলাম। তোমার যদি আপত্তি থাকে তো রেখো না।

রুনা এমন একটা ভঙ্গি করে যে আমি বুঝে উঠতে পারি না, সে আসলে কী বোঝাতে চাইছে। বলি, কোথায় থাকতে দিচ্ছ? রুনা বলে, কেন? বেডরুমে দিলে তোমার সুবিধা?

আমার মেজাজ খারাপ হয়। রুনার এই ইঙ্গিতপূর্ণ কথা অপমানজনক। কিন্তু কিছু বলার আগেই একটা গোঙানির শব্দ ভেসে আসে। তীর্থ আমার মোবাইলে ভিডিও ফাইলে ঢুকে পড়েছে। সেখান থেকে একটা বাজে ভিডিও চলতে শুরু করেছে। আমার দিকে তাকিয়ে কটমট চোখে রুনা বলে, ছেলেকে এইসবই শেখাবে তাহলে?

হড়বড়িয়ে তীর্থের হাত থেকে ফোন নিয়ে নিই আমি। ভিডিওটা বন্ধ করি। তীর্থ বলে, নঙ্গু নঙ্গু!

আমার হাত থেকে ঝটকায় মোবাইলটা নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে দেয় রুনা। ঝনঝনিয়ে ভেঙে যায় ফোনটা। পরে নতুন একটা মোবাইল কিনতে হয় আমাকে। সেই অর্থে নতুন ফোনের বয়স আর এ বাসায় ঝুমুরের বয়স এক সমান—ছয় মাস!

দুই.
গতকালকের মাংস ছিল—সেটা দিয়ে পরোটা খেতে খেতে অনলাইনে নিউজপেপার দেখছিলাম। তীর্থ ওটস খাবে না। সেটা নিয়ে রুনার সঙ্গে একপশলা বিবাদ হয়ে গেছে। এরপর কিছু একটা হলেই রুনা তীর্থকে পেটাবে। বিস্ময়করভাবে সত্য যে আমি মনে মনে সেই সময়টার অপেক্ষাও করছি। কিন্তু রুনা আজকে অন্য ছুটির দিনের চেয়ে আশ্চর্য রকম শান্ত। জুসের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে যেন কথার কথা বলছে, এমনভাবে বলল, ঝুমুরকে টাকা দিয়েছিলে কোনো?

আমি বললাম, না তো।

রুনা বলল, ওর কাছে কিছু দিন আগে বেশ কিছু টাকা দেখেছিলাম!

আমি বললাম, ওর কাছে?

রুনা বলল, হুম। ওর ব্যাগ ঘেঁটে পেয়েছিলাম। ছয় হাজারের মতো।

আমি বললাম, তুমি ওর ব্যাগ ঘাঁটতে গেছিলে নাকি?

রুনা বলল, তুমি দিয়েছিলে টাকা?

আমার নাশতা শেষ। তীর্থ বলল, তুমি আমাকেও তাকা দাও বাবা। তুমি মাম্মাকেও তাকা দাও। তুমি জুমুকেও তাকা দাও। তুমি ভালো বাবা।

আমি বললাম, আমি ঝুমুরকে টাকা দিইনি।

রুনা বলল, তাহলে অতগুলো টাকা সে কোথায় পেল?

আমি বললাম, তার আমি কী জানি?

রুনা বলল, তুমি অতগুলো টাকা ওকে কেন দিয়েছিলে শিহাব?

আমি বললাম, আমি কোনো টাকা দিইনি দিইনি দিইনি!

বারান্দায় সিগারেট জ্বালালাম। শেষ সিগারেট। এখন নিচে গিয়ে সিগারেট আনতে হবে। ঝুমুর থাকলে ঝামেলা হতো না। ওকে টাকা দিলেই চট করে নিয়ে আসত। মেয়েটা ছিল কাঠবেড়ালির মতো—ছটফটে! চনমনে! কিছুদিন আগে সে আমার কাছে টাকা চেয়েছিল। বলেছিল, তার হাজার দশেক টাকা দরকার।

এমন কথা তার আমাকে বলার কথা না। কিন্তু বলেছিল। বলার সময় মনে হয়েছিল ভীষণ ত্রস্ততার মধ্যে আছে। আমি বলেছিলাম, এত টাকা কেন লাগবে?

ঝুমুর বলেছিল, লাগবে সার। ম্যালা বিপদ!

আমার আর ওর বিপদের কথা শোনা হয়নি। ইচ্ছা যে করেনি, তা না। মনে হয়েছিল আসলে কী দরকার, একবার জানা উচিত। কিন্তু ততক্ষণে তীর্থ চলে এসেছিল। তীর্থকে নিয়ে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। ঝুমুর চলে গিয়েছিল।

পরে দশ হাজার টাকা আলাদা করে রেখেছিলাম। আলাদা মানে আটানব্বই হাজার টাকার একটা বিল পেয়েছিলাম কাজের। সেটা থেকে দশ হাজার নিজের কাছে নিয়ে বাকিটা ব্যাংকে জমা করে দিয়েছিলাম। ঝুমুরকে বলেছিলাম, কবে লাগবে তোর টাকাটা?

ঝুমুর বলেছিল, আইজ হইলে আইজ! কাইল হইলে কাইল সার!

আমি কালকে দেব ভেবেছিলাম। এভাবে কয়েকটা কাল পার হয়ে গেলে ঝুমুর নিজেই হাওয়া! আমার খয়েরি প্যান্টের সামনের পকেটে এখনো রাখা আছে টাকাটা। মনে হতেই সিগারেট নিভিয়ে ছুটে গেলাম ঘরে। খয়েরি প্যান্টটা চেক করলাম। টাকা নেই। মানে টাকাটা নিয়েই হাওয়া হয়েছে ঝুমুর—চোর!

তিন.
আড়াইটা থেকে তিনটার মধ্যে তীর্থ ঘুমিয়ে যায়। ছুটির দিনে আমার ঘুম আসে না দুপুরে। অথচ অফিসে ঢলে পড়ি। তীর্থর শূন্য ঘোড়াটার দিকে তাকিয়ে থাকি। রুনা বাসন মাজছে। ওর ঠান্ডার ধাত আছে। আজকে হয়তো শ্বাসকষ্ট হবে। নতুন একটা কাজের মেয়ে দেখতে হবে; বা হয়তো ঝুমুর ফিরে আসবে। হয়তো রাগ হয়েছে, চলে গেছে। ট্রেন ধরে গ্রামে চলে গেছে। পেটে টান পড়লে আবার ফিরে আসবে। তার না একটা মোবাইল ছিল? রুনাকে প্রশ্নটা করতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় নিশ্চয় সে কল দিয়েছিল—বন্ধ পেয়েছে। আর তখনই নিশ্চিত হয়েছে যে ঝুমুর পালিয়েছে!

কাজ গুছিয়ে রুনা ঘরে এলে একটু চাপা স্বরে বলি, তোমার খুব ঝামেলা হয়ে গেল, না? আমি কালকেই মতিন সাহেবকে বলছি…ওনার ফ্ল্যাটে নাকি কে একজন আছে—বুয়া সাপ্লাই দেয়!

রুনা কিছু বলে না। তার নীরবতা ভালো লাগে না। অস্বস্তি হয়। মনে হয় টাকার প্রসঙ্গটা বলা দরকার। জানানো দরকার ঝুমুর চোর—চুরি করেই গেছে। কিন্তু টাকাটা কিসের, এ প্রশ্নের উত্তর কী হবে, সেটাও বুঝতে পারি না।

রুনা বলে, তুমি ওর গায়ে হাত দিছিলা?

প্রশ্নটা রুনা করে আকস্মিকভাবে। আমি হতচকিত হয়ে যাই। তাকাই বিস্ময়ে। বলি, কার?

রুনা বলে, আকাশ থেকে পড়ার ভান ধরবা না! তোমার চাহনির মধ্যেই সব জানা যায়! তুমি ওর গায়ে কয়বার হাত দিছ?

আমার প্রথমে রাগ হয়। প্রচণ্ড রাগ। কিন্তু রাগের সঙ্গে সঙ্গে কেমন একটা অপরাধবোধও হতে থাকে। আমি যেন নিজেকেই জিজ্ঞেস করতে থাকি, আমি ঝুমুরের গায়ে হাত দিয়েছি কি না!

ঝুমুর একবার কফির মগ উল্টে ফেলেছিল আমার জুতায়—সেদিন তার গায়ে হাত দিতে ইচ্ছা করেছিল। তাকে পেটাতে ইচ্ছা করেছিল। মনে হয়েছিল লালচে চুলগুলো ধরে একটা ঝটকায় ফেলে দিই হারামিটাকে—কিন্তু পারিনি তো! সে ‘মাফ কইরা দেন স্যার, মাফ কইরা দেন স্যার’ বলে তাড়াতাড়ি জুতাটা মুছে দিয়েছিল।

রুনা বলে, ছুটির দিনের এই দুপুরবেলাগুলাতে পানি খেতে তুমি বারবার যেতে না রান্নাঘরে?

আমারও মনে হতে থাকে, সত্যি তো দুপুরবেলাগুলোতে বারবার পানি খেতে আমি যেতাম রান্নাঘরে। আর সব কাজ সেরে রান্নাঘরে মাদুর পেতে শুয়ে থাকত ঝুমুর। ঘুমিয়ে থাকত না, কিন্তু চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে থাকত। একদিন হাসতেও দেখেছি। হাসলে ঝুমুরের টোলও পড়ত, মনে আছে।

রুনা বলে, তুমি কি অর সাথে শুয়েওছ?

এমন প্রশ্নে আমার রাগ করা উচিত। কিন্তু আমি রাগ করতে পারি না। জোর কণ্ঠে কিছু বলতে পারি না। জোরে কথা বললে তীর্থ উঠে যাবে ঘুম থেকে। আর না উঠলেও আমি তেমন কোনো জোর পাই না কণ্ঠে। রুনা বলে, আমি ঘুমিয়ে গেলে প্রত্যেক রাতেই তুমি জোর করে শুতে, না? আর এ জন্যই সে পালিয়ে গেছে, তাই না? কোনো কিছু না নিয়ে শুধু জানের ভয়ে পালিয়ে গেছে, না? আমি বলি, সে টাকা নিয়েছে! দশ হাজার টাকা! আমার প্যান্টের পকেট থেকে দশ হাজার টাকা নিয়েছে। এমনি এমনি পালায়নি। সে চোর…

তোশকের নিচ থেকে আমার দশ হাজার টাকা বের করে দেয় রুনা। বলে, মেঝেতে পড়ে ছিল...

আমি টাকাটা নিতে পারি না, রুনার চোখের দিকেও তাকাতে পারি না। তীর্থ ঘুমের মধ্যে হাসে—হয়তো স্বপ্নের মধ্যে হাসে।

চার.
সন্ধ্যায় মর্গে যেতে হয় আমাদের।

তীর্থকে নিয়ে আমি আমগাছ তলায় দাঁড়িয়ে থাকি। রুনা গিয়ে লাশ শনাক্ত করে আসে। বাইরে বেরিয়ে তার শ্বাসকষ্ট হয়। ঠেলে ঠেলে বমি উঠলেও বমি করতে পারে না।

মহাখালি রেলক্রসিংয়ে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ছিল ঝুমুর। পরে ট্রেন এলে সে ইঞ্জিন জড়িয়ে ধরতে চায়। বাম পাশটা পুরো গুঁড়ো হয়ে গেছে বলে ঠিকমতো চেহারা চেনার উপায় নেই।

ঝুমুরের চাচিকে দশ হাজার টাকা দিই লাশ গ্রামে নেওয়ার জন্য। তারা রাতেই রওনা দেবে বলে জানায়। রান্নার হাঙ্গামা হবে বলে ওদিক দিয়ে আমরা পুরান ঢাকায় চলে যাই। বিরানি খেতে বসলে রুনা বমি করে ফেলে আর গভীর রাতে তার জ্বর আসে। ওর মুখের দিকে আমি তাকাতে পারি না। বেদনায় নীল হয়ে যাচ্ছে ওর মুখ। ফিসফিস করে বলে, ঝুমুরের পেটে তোমার বাচ্চা আসছিল? অ্যাবরশন করাতা…এতটুকুন মেয়ের মরা ছাড়া আর কোনো রাস্তা রাখলা না তুমি!

রুনার মুখ থেকে সাদা ফেনার মতো বেরিয়ে আসতে থাকে। মায়ের এমন চেহারা দেখে কেঁদে ফেলে তীর্থ। আমার কোলের ভেতর গুটিসুটি মেরে বসে থাকে সারা রাত। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে তীর্থ। তাকে দেখতে একটা ভ্রূণের মতো লাগে। আমার ঘুম আসে, কিন্তু আমি ঘুমাতে পারি না।

পাঁচ.
রুনার অনুমান ঠিক হয়। কয়েক দিন পর ঝুমুরের ফরেনসিক রিপোর্ট পাওয়া যায়। ক্লিয়ার সুইসাইড—এবং গর্ভে চার মাস সাত দিনের সন্তান। আমি রুনার দিকে তাকাতে পারি না, রুনাও আমার দিকে তাকায় না। আমি বলি, এসব কিছুই হয়নি, রুনা। ঝুমুরের মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী না। কিন্তু আমি জোর গলায় কিছু বলতে পারি না। আমার মনে হতে থাকে ঝুমুরের মৃত্যুর জন্য বোধ হয় আমিই দায়ী। ফলে আমার আর রুনার মধ্যে না-থাকা ঝুমুর অনেক বেশি করে থাকতে শুরু করে। একটা অচলাবস্থার মধ্যে আমাদের দিনগুলো বয়ে যায়। আমরা একই সঙ্গে থাকি, আবার থাকি না। আমরা একই সঙ্গে খাই, ঘুমাই কিন্তু আমরা কেউ কারও সঙ্গে থাকতে পারি না। আমি অফিস করি, বাজার করি, ছুটির দিনগুলোতে সিগারেট আনতে যাই মহল্লার দোকানে। আর দোকানে গেলে দোকানি জব্বারের হাতে আমার অব্যবহৃত, ড্রেসিংয়ের ড্রয়ারে পড়ে থাকা, হাতঘড়িটা দেখি। বারবার দেখি। কিন্তু কখনো ঘরে এসে দেখতে ইচ্ছা করে না আমার ঘড়িটা ড্রেসিংয়ের ড্রয়ারে রয়েছে কি না। আমার মনে হয়, আমার আর রুনার সময় আটকে গেছে, কোনো ঘড়িতেই আর সেটাকে চালু করা সম্ভব হবে না।

তীর্থ শুধু বড় হতে থাকে আমাদের সম্পর্কের দূরত্ব ও শীতলতার মধ্যে।

Tuesday, December 31, 2019

প্রেমের গল্প: খণ্ডিত চাঁদের ভেতর


এখান থেকে আলতামির দুইটা পথ বেছে নিতে পারে—যেতে পারে ঢাকার দিকে—যে দিকটা সে তিনটা ঘণ্টা আগেও ফেলে আসতে চেয়েছিল। ঢাকা মানেই মৃত্যু হয়ে উঠেছিল আলতামিরের জন্য। শ্বাস নেওয়ার প্রতিটা সময় ছিল ভীতিকর। পেঁয়াজপট্টির ভেতর দিয়ে, মুখের ওপর গামছা চাপিয়ে, পদ্মর হাত ধরে যখন সে ছাড়ছিল কারওয়ান বাজার, মনে মনে খোদার কসম কেটেছিল আলতামির—জান থাকতে আর কোনোদিন ঢাকায় ফিরবে না সে। না, শুধু সে নয়। সে আর পদ্ম।

তা কাজটা তারা কম মন্দ তো করেনি।

সরদারের ডেরায় থেকে, সরদারেরই চোখের আড়ালে তারা প্রেম করেছে। এ যেন পানির ভেতর থেকে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ। কিন্তু আলতামিরের এক গোঁ…যে কুমির, তার সঙ্গে বিবাদে ভয় নেই, যদি ডাঙা থাকে পায়ে!

ডাঙা এখন আলতামির আর পদ্ম দুজনেরই পায়ের তলায়। প্রায় ১৭ কিলোমিটার উড়ে এসে এই যে ব্রিজের ওপর উত্তর-দক্ষিণের দুটো পথ…একটা ঢাকা—মৃত্যুর, অন্যটা উন্মুক্ত—জীবনের! তবে তাতেও সন্দেহ হয় আলতামিরের। তার ধূর্ত চোখ বুঝে গেছে ওপাশেও হেডলাইট জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে সরদারের আজ্ঞাবাহী ছায়ারা। সরদার শুধু কারওয়ান বাজারের ওপর যে ছড়ি ঘোরায় তা নয়, বরং তার লোক ছড়িয়ে আছে দশ দিকে। কুলিগিরি করতে গিয়েই তো পদ্মর চোখে মজেছিল আলতামির, কাজল না দেওয়া ডাগর চোখে কী যে হাতছানি! বাজার থেকে কাঁচা সুপারির খদ্দের পদ্ম, প্রতিদিন আলতামিরকে কাছে আসার সুযোগ দিত ভিড়ের মধ্যে। কোনো কোনো দিন যেন তাড়াহুড়ো করেই সন্ধ্যা নেমে যেত। সেদিন...আরও অনেক দিন...একদিন হাত ছুঁয়ে একদিন কাঁধ, আলতামির বুঝেছিল ঢাকার বস্তিঘর ছেড়ে তাকে কোনো জঙ্গলে যেতে হবে। যদি পদ্মর প্রশ্রয় থাকে।

প্রশ্রয় তো ছিলই! না থাকলে সরদারের বউ হয়েও কেন পদ্ম এমন মোহন হাসে? সন্ধ্যার মুখে পটল কেনার নামে পানির ট্যাংকের পেছনে উদ্গ্রীব কেন চলে আসে? আর একাও যে আসে তা তো না…কত আবদার আর খুনসুটি থাকে সঙ্গে!

এক রাতে সরদার যখন বাংলা মদ গিলছিল, তখন আলতামির শক্ত করে ধরে পদ্মর হাত। ঢাকাকে বিদায় দিয়ে পৌঁছাতে চায় জঙ্গলে, ডাঙায়। কিন্তু রাতের এই স্তব্ধ ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে সে গুমগুম শোনে মোটরসাইকেলের শব্দ—দুপাশ থেকেই। উত্তরে ঢাকা—যেখানে কোনোদিন ফিরবে না তারা; আর দক্ষিণে পৃথিবী—যেদিকে কথা ছিল প্রেম আলিঙ্গন করবে তাদের। কিন্তু সরদারের শক্তিবলয় এখন দুপাশ থেকে ইঞ্জিনের শব্দ তুলে অপেক্ষমাণ। তাই দক্ষিণে গিয়েই ফিরে আসতে হয় তাদের, মৃত্যুর মুখ এমন কালো হয় কেন? এরচেয়ে কি ভালো ঢাকার সরদার…ক্ষমাও যদি মিলে যায়! কিন্তু ভালোবাসা নিয়ে ক্ষমাই বা চায় কীভাবে মানুষ?

তাহলে পথ নেই কোনো!

একটা বিন্দুর মতো চাঁদ অনেক নিচের সরু এক সুতানদীতে নিজেকে আছড়ে রেখেছে। আলতামিরের হাসি পায় এই দুর্যোগেও। পথ না থাকলে চাঁদের আলো কোন কাজে আসে? উত্তরে ফেরা যায় না এ আলোয়…দক্ষিণ থেকে হা রে রে রে করে ছুটে আসতে থাকা কালো মৃত্যুর মুখেও এ আলো ভীষণ অকার্যকর!

অথচ দুটো বন্ধ পথকে তীব্রভাবে ভেঙিয়ে পদ্ম আর আলতামির পরস্পরকে প্রবলভাবে জড়িয়ে ধরতেই তাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে তৃতীয় পথ। চাঁদ তাদের সাহায্য করে হয়তো। অথবা কবেকার শোনা পালাগান, আরব্য রজনী বা পাখিরা হয়তো তাদের মাথার ভেতর ডেকে ওঠে হঠাৎ করেই। তারা দুজন দুজনাকে ধরে তৃতীয় অতিকায় এক পথ সৃষ্টি করে লাফিয়ে পড়ে ব্রিজ থেকে।

তারা পাখি নয় বলে উড়ে যেতে পারে না। তারা মায়াবী নয় বলে মিলিয়ে যেতে পারে না বাতাসে। তবে অনেক নিচের চাঁদকে তারা দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। লোকে বলে, ভালোবেসে এর আগেও অনেকেই চাঁদকে এমন দ্বিখণ্ডিত করে গেছে!

Monday, September 30, 2019

জীবনের গল্প: দাগ



শহরের এই পাশটা এখনো গ্রামের মতো সুনসান। খুব একটা বাড়িঘর ওঠেনি। মূল সড়ক থেকে একটু ভেতরের দিকে গেলে চোখে পড়বে দু-একটা পাকা দালান। শেষ হয়নি সেগুলোর নির্মাণকাজও। কঙ্কালসদৃশ এসব ভবনের চারপাশ থেকে হাড়গোড়ের মতো বেরিয়ে আছে কোথাও লম্বা, আবার কোথাও ছোট-বড়, মোটা-চিকন রড। গায়ে সিমেন্টের পলেস্তারা পড়েনি ঠিকমতো। শুধু কাঠামোটা দাঁড়িয়ে আছে।

এই নগ্ন নির্জন বাড়িগুলোর আশপাশের কয়েকটা প্লটে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো চোখে পড়বে বালুর স্তূপ। কোথাও সারি সারি করে রাখা আছে ইট। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সেগুলোর গায়েও সবুজ শেওলা পড়ে গেছে। আরও আছে লম্বা লম্বা ঘাস। এসবের ভেতর দিয়ে চলে গেছে মাটির সরু রাস্তা। তার গায়ে বড় বড় গর্ত। গর্তের ভেতরে বৃষ্টির পানি জমে একেকটা ছোটখাটো পুকুর। রাস্তার দুপাশে কখনো কখনো ঘন কাশবন। এর ভেতর দিয়েই দিনের বেলায় দু-একটা ট্রাককে খ্যাপা ষাঁড়ের মতো চারপাশের সবকিছু দুমড়ে-মুচড়ে ছুটে যেতে দেখা যায়।

অনেক দিন পর এই এলাকায় ঘুরতে এসেছেন মইন আলী। শুক্রবার হলে সপরিবার কোথাও না কোথাও বেড়াতে যান তিনি। দূরে কোথাও না গেলেও অন্তত বাড়ির কাছেই কোনো একটা রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয় তাদের। মইনই আজ প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন তার স্ত্রীকে: ‘চলো, আজ শহরের বাইরে কোথাও থেকে ঘুরে আসি।’

‘বাইরে কোথায়? বেশি দূরে?’
‘না না, বেশি দূর না, এই তো এয়ারপোর্টটা পার হলেই হাতের বাঁয়ে পড়বে। এলাকাটার কথা অনেক শুনেছি। কিন্তু কখনো যাওয়া হয়নি, ‘ওয়ার্ডরোব থেকে নতুন একটা শার্ট বের করে তার ভাঁজ খুলতে খুলতে মইন বললেন, ‘গিয়েছিলাম একবার। কিন্তু অনেক আগে। রাতের বেলায় বলে ঠিকমতো কিছু দেখতেও পাইনি।’

‘ওখানে হঠাৎ?’
‘শুনেছি এখনো কিছু জমি বিক্রি হচ্ছে। দামেও নাকি সস্তা। তোমাকে তো আর গুলশান-বনানীতে বাড়ি বানিয়ে দিতে পারব না। তাই ওখানে একটু চেষ্টা করে দেখি।’

ফওজিয়া আর কথা বাড়াননি। খুব দ্রুত সুতির একটা শাড়ি জড়ালেন শরীরে। লাল পাড়ের অফ হোয়াইট। ঠোঁটে না লাল না গোলাপি লিপস্টিক দিলেন। কপালে কমলা রঙের বড় একটা গোল টিপ। হাত দুটো ভর্তি করলেন সাতরঙা কিছু চুড়িতে। তারপর হাতব্যাগটা বগলের নিচে চালান করে দিয়ে, নিচে নামার জন্য দুজন ঢুকে গেলেন লিফটের ভেতরে। ফওজিয়া খেয়াল করলেন, তার স্বামীর গা থেকে খুব সুন্দর একটা গন্ধ আসছে। এই পারফিউমটা আবার কবে কেনা হলো, মনে মনে ভাবলেন ফওজিয়া। কিন্তু এ নিয়ে কিছু বললেন না। বরং মাথাটা উঁচু করে, মইনের মুখের দিকে তাকিয়ে, খুব মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘ইউ আর সো হ্যান্ডসাম মাই ম্যান।’

ডিসেম্বরের বিকেলের বাতাসে, ব্যস্ত শহরে কচ্ছপগতির যানবাহনের ফাঁকফোকরের ভেতর দিয়ে, গাড়ি চালাতে চালাতে মইন আলী ভাবছিলেন, যা কিছু করার এখনই করতে হবে। তিনি এখন যে পজিশনে আছেন, তার নিজের জন্য কিছু করার এটাই সবচেয়ে মোক্ষম সময়। এখন দলের সিটি কমিটির নেতা। গত বছর সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছেন। তার কানেকশনও ভালো। দলের ওপরের মহলে এবং সরকারের ভেতরে তার অবাধ যাতায়াত। বন্ধুরাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন বাহিনীতে। তার ক্ষমতার হাতও এতখানি দীর্ঘ যে কেউ কিছু চাইলে সেটা তিনি মোটামুটি করে দিতে পারেন। সে কারণে তার নিজের চাওয়া-পাওয়ারও একটা দাম আছে অন্যদের কাছে। পরে কী হয় কে জানে, তাই এখন ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না। তিনি জানেন, ঘুমন্ত শৃগাল কখনো শিকার ধরতে পারে না।

তারা চলে এসেছেন বেশ দূরে। শহরের বাইরে হলেও এই এলাকায় সম্প্রতি কতগুলো দেশি রেস্তোরাঁ খুলেছে। দেখতে আহামরি কিছু নয়, খুব সাধারণ। লোকে বলে বাংলা হোটেল। বাঁশ দিয়ে তৈরি। চারপাশটা খোলা। কোনো দেয়াল নেই। রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে মাথার ওপরে শুধু টিনের ছাদ। ভেতরে কাঠের টেবিল পাতা। সারি সারি। অতিথিরা বসেন বেঞ্চিতে। টেবিলের চারপাশ দিয়ে আড়াআড়ি করে রাখা লম্বা লম্বা টুল। বাঁশের।

মইন তার কয়েকজন সহকর্মীর কাছে শুনেছেন, দেখতে ভাঙাচোরা হলেও এসব রেস্তোরাঁর খাবার খুবই সুস্বাদু। কারণ, এখানে লাকড়ি দিয়ে রান্না হয় মাটির চুলায়। প্রায় সব ধরনের ভর্তা, ভাজি, মাছ ও সবজির তরকারি পাওয়া যায়। তরতাজা আর ফরমালিনের অভিশাপ থেকে মুক্ত এসব খাবার।

মইন আলীর ইচ্ছে আজ এখানেই ডিনার শেষে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু কথাটা এখনো বলা হয়নি ফওজিয়াকে। গাড়িটা রাস্তার এক পাশে, হাইওয়ে থেকে যেখানে একটা কাঁচা রাস্তা একটু নিচু হয়ে হঠাৎ করে জমির দিকে কাত হয়ে নেমে গেছে, সেখানে পার্ক করে তারা দুজনে একটু হাঁটাহাঁটি করলেন। এ রকম খোলা জায়গায় বহুদিন আসেননি ফওজিয়া। মৃদুমন্দ বাতাসে তার শাড়ির আঁচল উড়তে লাগল। সেই সঙ্গে কিছুটা চঞ্চল হলো তার চিত্তও। প্রকৃতির কারণে তার মনের ভেতরে যে এ রকম একটা শিহরণ তৈরি হতে পারে, সেটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি।

সোজা হাঁটতে হাঁটতে আরও পশ্চিম দিকে চলে গেলেন তারা। দেখলেন, ভেতরের দিকে শুধু প্লটের পর প্লট। কোথাও সীমানা দেওয়া, কোথাও সীমানা ছাড়া। কোথাও কোমরসমান ইটের দেয়াল, আবার কোথাও সীমানা থাকলেও সেটা চাপা পড়ে গেছে লম্বা লম্বা ঘাসের আড়ালে। লাল সুরকির রাস্তা ধরেই এগোতে লাগলেন ওঁরা। দুপাশে কোথাও পড়ল ছোট ডোবা, তার মধ্যে টলটল করছে পরিষ্কার পানি, কোথাও কোনো এক প্লটের গর্বিত মালিক বালুর মধ্যেই শখ করে লাগিয়েছে পেয়ারাগাছ। পাতাগুলো হলুদ হয়ে মরে যাচ্ছে।

দূরের একটা পাইলনকে টার্গেট করে এগিয়ে গেলেন দুজন। কিছুক্ষণ পর সাইকেল নিয়ে ছুটে এল রুগ্ণ এক তরুণ। সে ভেবেছিল, ওরাও হয়তো কোনো একটা প্লটের মালিক। জানতে চাইল, ওরা জমিতে বালু ফেলবেন কি না। মইন তখন তার কাছে কিছু খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করলেন। বিক্রির জন্য কোথায় কোথায় এখনো জমি আছে, কতটুকু জমি, ঝামেলামুক্ত কি না, মালিক কোথায় থাকেন, আরও জানতে চাইলেন ওসব জমি এখন কত করে বিঘা।

হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় এসে থামলেন তারা। অবশ্য সামনে এগোনোর আর কোনো সুযোগও নেই। এরপর বিশাল একটি বিল, যেটা ওপাশে নদীর সঙ্গে মিশেছে। বিলের ভেতরে একটা খালি নৌকা। আর এক পাশে জাল ফেলে বসে আছেন একজন বৃদ্ধ জেলে।

বছর তিনেক আগে, ঠিক মনে নেই কোন মাসে, এই এলাকায় একবার এসেছিলেন মইন আলী। ঘটনাক্রমে। এখানে আসার কোনো পরিকল্পনাই তার ছিল না। পুলিশই অনেকটা জোরাজুরি করে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল তাকে। এখানকারই কোনো একটা জায়গায় হবে, একেবারে ঠিক এখানে না হলেও হবে আশপাশের কোথাও, মধ্যরাতের পর এক প্লাটুন বাহিনী নিয়ে দুটো জিপ গাড়িতে করে তারা এসেছিল ঝড়ের গতিতে।

কিন্তু আজ তার কিছুই চিনতে পারছেন না মইন আলী। চেনার কথাও না। ওই রাতে আকাশে চাঁদও ছিল না। চারপাশজুড়ে ছিল শুধু অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার ভেতরে ছিল আগুনের ফুলকির মতো সহস্র জোনাকির আলো। মইনের এখনো মনে পড়ে, খুব ঘন ছিল ওই রাত। দুধের সরের মতো জমাট অন্ধকার চিরে জিপের হেডলাইট ও টর্চের আলোতে মইন কত দূর কী দেখেছিলেন, সেসব তার আর মনে নেই। কিন্তু ওই রাতে বুকে কাঁপন ধরানো ঝিঁঝি পোকার বীভৎস সব ডাক তার কানে এখনো গেঁথে আছে।

ফওজিয়া তখন একটু দূরে। ডুবে আছেন নিজের আপন জগতে। এই ভুবন তার নিজস্ব। মইনেরও প্রবেশাধিকার নেই সেখানে। গুনগুন করে গান গাইছেন। একসময় গুটি গুটি পায়ে হারিয়ে গেলেন কাশফুলের ঘন ঝোপের ভেতরে। বেরিয়ে এলেন কিছুক্ষণ পর। মইন তখন পকেট থেকে তার ফোনটা বের করলেন। দূর থেকে কয়েকটা ছবি তুললেন স্ত্রীর। তারপর সদ্য তোলা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো, বিয়ের দিন যে রকম দেখেছিলেন, ঠিক সে রকমই আছে জয়া (ফওজিয়া), কিন্তু প্রায়ই তার মনে হয়, ফওজিয়া আসলে অনেকখানি বদলে গেছেন!

এতক্ষণে চারপাশের সোনারোদ মরে গেছে। মইন আলী দেখলেন, একটু আগেও যে সূর্যটা তালগাছগুলোর মাথার ওপরে ঝুলেছিল, সেটা খুব দ্রুত নিচের দিকে নামতে লাগল। যেন এখনই ওটা বিলের পানিতে টুপ করে পড়ে যাবে। আজ ওর এত তাড়া কিসের? মইনের মনে পড়ল, লিফটে নামার সময় দেখেছেন, ফওজিয়াও আজ এ রকমই একটা টিপ পরেছেন কপালে।

ওরা যখন হাইওয়েতে উঠে এল, সূর্যটা তখন বিলের পানিতে তার সমস্ত রং গলিয়ে ডুবে গেছে গ্রামের ওপাশে। ধীরে ধীরে চারপাশে ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। মইন গাড়ির ভেতরে ঢুকে ফওজিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে হেডলাইট অন করলেন। বললেন, ‘এখানে ডিনার করলে কেমন হয়?’

‘এইখানে!’ ভ্রু কুঁচকালেন ফওজিয়া।
হুম্, অসুবিধা কী জয়া? একদিন খেয়েই দেখো না!
পেট খারাপ করবে না তো আবার?
দুনিয়ার মানুষ খাচ্ছে না বুঝি! মইন তার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন।
কিন্তু এখনো তো ডিনারের সময় হয়নি।

গাড়ির ড্যাশবোর্ডে সময় দেখলেন মইন আলী। সাতটার মতো বাজে। ‘অসুবিধা নেই। চারপাশে একটা চক্কর দিলে সময় কেটে যাবে, জায়গাটাও দেখা হবে,’ এটুকু বলে হুশ করে হাইওয়েতে ওঠে এলেন মইন।

পাশাপাশি কয়েকটা হোটেল দেখে গাড়ি থামালেন মইন আলী। তার সামনে আরও কিছু গাড়ি এলোপাতাড়ি দাঁড় করানো। একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে প্রথমে চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখলেন তিনি। খুব বেশি ভিড় নেই আজ। দেখলেন দুটো পরিবার পাশাপাশি বসে গল্প করতে করতে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছে।

রেস্তোরাঁর ভেতরে কিছুক্ষণ পায়চারি করে ফওজিয়া কোনার একটি টেবিলে গিয়ে বসেছেন। কখনো কোথাও গেলে তিনি প্রথমে এ রকম একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বের করবেন, এটাই যেন ধরাবাঁধা নিয়ম। বাইরে গেলেও লোকজন এড়িয়ে চলবেন ফওজিয়া, কথা বলবেন কম। তার কানের পাশে মানুষের উচ্চকণ্ঠ, চোখের সামনে পরিচিত-অপরিচিত লোকজনের হাঁটাচলা তাকে খুব অস্থির করে তোলে। মইন যখন এসব নিয়ে তার স্ত্রীকে কোনো প্রশ্ন করেন, ফওজিয়ার সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘ভাই, এটা আমার অসুখ। তো আমি কী করব বলো?’

ফওজিয়া আলী তার ছোট্ট পরিবার নিয়ে—পরিবার বলতে শুধু তার স্বামী আর একজন গৃহপরিচারিকা রাসেলের মা—নিজের মতো করে গুটিয়ে থাকতে চান। কিন্তু আগে তিনি এ রকম ছিলেন না। বিয়ের পর মইন দেখেছেন, তার জয়া খুব হাসিখুশি আর প্রাণোচ্ছল ছিল। সব সময় শান্ত-স্নিগ্ধ আর চোখজুড়ানো একটা হাসি লেগে থাকত মুখে। তাকে তো বটেই, বাড়ির সবাইকে মাতিয়ে রাখত সে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স-মাস্টার্স করা ফওজিয়া লেখাপড়া শেষ করে একটা ইংরেজি দৈনিকে চাকরিও নিয়েছিলেন। মফস্বল পাতার এডিটর হিসেবে। নিজের কাজ নিয়ে খুব গর্বও করতেন তিনি। বাড়িতে ফিরে মইনের সঙ্গে সারাক্ষণ বকবক করতেন। এ জন্য মইন কখনো কখনো, মজা করে, তার স্ত্রীকে ‘বিবিসি’ বলেও ডাকতেন। ফওজিয়া তার স্বামীকে বলতেন আজ কোথায় কী কী ঘটেছে, কোন জেলার কোন রিপোর্টার কী খবর পাঠিয়েছে। তারপর মোহাম্মদপুরে, ওরা যেখানে থাকে, তার কাছেই নাকি একজন তরুণ পুলিশের সঙ্গে ক্রসফায়ারে মারা গেছে।
‘আচ্ছা, মইন, তুমি কি কাল রাতে গোলাগুলির শব্দ শুনেছ?’

ওরা তখন খাবার টেবিলে। একটু আগে ফওজিয়া অফিস থেকে ফিরেছেন। কিন্তু অন্যান্য দিনের চেয়ে তাকে একটু বেশি অস্থির লাগছিল। মইনের প্লেটে ভাত তুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘কোথায়?’ জানতে চাইলেন মইন।
‘বেড়িবাঁধের ওপারে। রাত দুটা-তিনটা হবে। তখন নাকি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশের প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়েছে।’
‘হতে পারে জয়া। সন্ত্রাসীরা আজকাল খুব বেশি ঝামেলা করছে। লোকজনের ঘুম হারাম হওয়ার মতো অবস্থা। ও রকম দু-একটা মরলে তবে শান্তি।’
‘পুলিশের প্রেস রিলিজেও সে রকম লিখেছে। কিন্তু আমাদের রিপোর্টার বলছে, নিহত ছেলেটি বিরোধী দলের। হরতাল হলে ও-ই নাকি রাস্তায় থাকত। তোমাদের দলের এক নেতারও নাকি হাত আছে এই ক্রসফায়ারের পেছনে।’

‘কী যে বলো তুমি, এ-ও কি কখনো হয়, আমরা বললাম আর পুলিশ ঠুস করে মেরে ফেলবে?’
‘আমাদের রিপোর্টার ইনভেস্টিগেট করছে।’
‘করুক, তখন দেখবে যে কেমন সত্যটা বেরিয়ে আসে। কিন্তু এখন তো ঘুমাতে দেবে, নাকি?’

এ রকম আরও কত ধরনের খবর দেন ফওজিয়া তার স্বামীকে। বেশির ভাগ খবরই তিনি স্বামীর সঙ্গে শেয়ার করেন ডিনারের টেবিলে।
এ রকম করেই চলছিল দিন। কিন্তু কয়েক বছর পর হঠাৎ করে কী যেন হলো ফওজিয়ার, একদিন হুট চাকরি ছেড়ে দিলেন। মইন জানতেন না সেটা। এ বিষয়ে তাকে কিছু বলেনওনি ফওজিয়া। মইন দেখলেন, স্ত্রী টানা কয়েক রাত তাকে কোনো খবর দিচ্ছেন না। খাবারের টেবিলে বসে, আর তিনিও তেমন কিছু জানতে চান না। চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে যান বিছানায়। মইনের প্লেটের দিকেও তার চোখ নেই। একদিন, সম্ভবত বুধবার হবে, সেদিন রাতে খুব বিচ্ছিরি একটা গরম পড়েছিল, বিদেশি চ্যানেলে একটা মুভি দেখার পর মইন বিছানায় তার স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হতে হতে জানতে চাইলেন: ‘খবর কী বলো?’

‘তেমন বড় কিছু নেই,’ ফওজিয়ার নির্লিপ্ত উত্তর।
‘কী বলো! বিবিসির কাছে কোনো খবর নেই!’ স্ত্রীকে একটু চাঙা করতে চাইলেন মইন।
‘বিরক্ত করো না মইন, ঘুমাতে দাও তো প্লিজ।’ পাশ ফিরে স্বামীর দিকে পিঠ দিলেন ফওজিয়া।

মইনের তখন আর খবরের প্রতি অতটা আগ্রহ ছিল না, যতটা আগ্রহ ছিল ফওজিয়ার শরীরের জন্য। তৃপ্ত মইন যখন এক পাশে গড়িয়ে ছাদের দিকে মুখ দিয়ে শুয়ে পড়েন, সুখের রেশ তখনো তার শরীরে নদীর স্রোতের মতো পা থেকে মাথা পর্যন্ত কলকল করে বয়ে চলেছে, শরীর ঘেমে গেছে প্রচণ্ড গরমে এবং উত্তেজনায়। এসিটার দিকে তাকালেন তিনি। হিশ হিশ করে একটা শব্দ হচ্ছে। ভাবলেন, তাপমাত্রা আরও একটু কমিয়ে দিলে ভালো হতো। কিন্তু সমস্যা ফওজিয়াকে নিয়ে। এসির বাতাস তিনি মোটেও সহ্য করতে পারেন না। গরমেও কাঁথা লাগে তার। ফওজিয়ার নগ্ন ঊরুর ওপর পা তুলে দিয়ে মইন টের পেলেন, তার স্ত্রীর শরীর ইতিমধ্যেই ঠান্ডা হতে শুরু করেছে।

জংলাছাপ চাদরে পিঠ দিয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকালেন মইন। মশারির নেটের জন্য স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তিনি দেখলেন মশারির গায়ে ফ্যানের ব্লেডগুলো এমন একটা ছায়া তৈরি করেছে যে মনে হচ্ছে একটা মৃতদেহ পড়ে আছে রাস্তার কিনারে। ওই রাতেও ঘুমাতে পারলেন না তিনি।

একদিন দুপুরে ফওজিয়ার কাগজের সম্পাদকের একটা ফোন এল। খচখচ করে উঠল মইনের মন। ওপাশ থেকে সম্পাদক সাহেব তখন নিজের পরিচয় দিলেন: ‘কী সেক্রেটারি সাহেব, অনেক দিন দেখা হয় না আপনার সঙ্গে।’

জবাবে মইন বললেন, ‘‌জি। কী করতে পারি আপনার জন্য বলুন।’
‘কিছু করতে হবে না আলী ভাই। আপাতত বলেন তো দেখি ফওজিয়ার কী হয়েছে?’
‘কেন সামাদ ভাই?’
‘ও চাকরিটা হুট করে ছেড়ে দিল কেন?’ আকাশ থেকে পড়লেন মইন। এই প্রশ্নটা তার কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু সামলে নিলেন নিজেকে। এই খবরটা যে তার জানা ছিল না, সেটা তিনি সম্পাদক সাহেবকে বুঝতে দিতে চান না।

‘ফওজিয়া খুব ব্রাইট একটা মেয়ে। খুউব ভালো করছিল। মফস্বলের পাতার চেহারাটাই ও বদলে দিয়েছে। আমার সব জেলার করেসপনডেন্টরা ওকে খুব পছন্দ করে।’
চুপ করে রইলেন মইন। স্ত্রীর প্রশংসা শুনতে তার ভালোই লাগছিল।
‘আমি ভাবছিলাম ওকে ফ্রন্ট পেজে নিয়ে আসব। আর তখনই ও রিজাইন করে ফেলল!’ কথার মাঝখানে বাধা না দিয়ে মইন তখনো চুপ করে রইলেন। সম্পাদককে আরও কিছু বলার সুযোগ দিলেন তিনি। ‘এ জন্যই আপনাকে ফোন দিলাম। দেখেন তো বুঝিয়ে-শুনিয়ে যদি ওকে ফেরত পাঠাতে পারেন।’
‘অফিসে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?’ জানতে চান মইন।
‘সে রকম হলে আমাকে ও বলুক। আমি ব্যবস্থা নেব।’ সম্পাদকের উত্তর।
‘দেখি সামাদ ভাই, আমি কী করতে পারি। জানাব আপনাকে।’

এটুকু বলে ফোন রেখে দিলেন মইন আলী। রাতে বাড়িতে ফিরে প্রথমেই কিছু বললেন না স্ত্রীকে। খাবারের সময়ও না। পরে সোফায় ফওজিয়ার কোলের ওপর মাথা রেখে রিমোট টিপতে টিপতে কথাটা পাড়লেন তিনি। ‘জয়া, তোমার কি কোনো সমস্যা হয়েছে?’

‘কিসের সমস্যা!’
‘আমাকে বলতে পারো, আমি তো তোমাকে সাহায্য করতে পারি। নাকি?’
‘কই, আমার তো কোনো সমস্যা হয়নি।’ একটু বিরক্ত ফওজিয়া।
‘তুমি নাকি কাগজের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছ?’

ফওজিয়া আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন যে তাকে এ রকম একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে এখন। আর সে জন্য মনে মনে একটা উত্তরও গুছিয়ে রেখেছিলেন। ‘হুম্, আর ভালো লাগছে না।’
‘আমাকে বলোনি কেন?’
‘বলতাম। বলার সময় তো শেষ হয় যায়নি।’
‘কেন ছাড়লে? অফিসে কি কিছু হয়েছে?’
‘না না, ও রকম কিছু না। আমি ভেবে দেখলাম আমার নিজেকে কিছু সময় দিতে হবে। তোমাকেও সময় দেওয়া দরকার। আমাদের বিয়ের সাত-আট বছর হয়ে গেল। এখন তো একটা সন্তান নেওয়া উচিত, তাই না?’

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলেন। ফওজিয়া বললেন, ‘এখন না হলে আর কবে হবে।’
‘সময় তো আর শেষ হয়ে যায়নি,’ নির্লিপ্ত কণ্ঠে ফওজিয়ার কথাটা ফিরিয়ে দিলেন তিনি।

মইন আলী তার স্ত্রী ফওজিয়ার সঙ্গে তাদের বাচ্চা না হওয়া নিয়ে খুব বেশি কথা বলেননি কখনো। একেবারেই যে বলেননি তা নয়, বলেছেন, কিন্তু তাতে কখনো এ রকম অভিযোগের সুর ছিল না, বরং তাতে ছিল একে অপরের প্রতি মায়া ও ভালোবাসার প্রকাশ। যদিও এই শূন্যতা একটা গোপন কাঁটার মতোই বিঁধে ছিল তার মনের নরম ভূমিতে। এখন সেই রক্তাক্ত জায়গাটা ফওজিয়া হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন সরাসরি।

মইন জানেন যে এই দীর্ঘশ্বাস শুধু তার একার নয়। এই কষ্টটা ফওজিয়ারও সমান। কিন্তু এর জন্য কে দায়ী, সেটা তো তারা কেউই জানেন না। এ রকম কোনো টেস্টও করা হয়নি এখনো। ডাক্তারের কাছে যাব যাব করেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। মইনের মা ও বোনেরা কয়েকবার প্রশ্নটা তুলেছিলেন, কিন্তু মইন সেটাকে বাড়তে দেননি। শুধু ভেবে রেখেছেন দুজনেই কোনো এক সময়ে সিঙ্গাপুরে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আসবেন।

ফওজিয়ার মুখে বাচ্চা নেওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা শোনার পর স্ত্রীর চাকরি ছাড়া নিয়ে আর কিছু বলেননি মইন। তিনি জানেন, মেঘের ভেতরে বৃষ্টি জমে থাকার মতো ওই আকাঙ্ক্ষার পেছনেও লুকিয়ে আছে একটা গভীর হতাশা। কিন্তু ফওজিয়া সেই হতাশার কথা তার কাছে গোপন রেখেছেন, যেমনটা রেখেছেন তিনি নিজেও। এক মশারির ভেতরে, এক ফ্যানের নিচে, এক চাদরের উপরে তারা পাশাপাশি থাকেন, কিন্তু তারা কেউই একে অপরের এই দীর্ঘশ্বাস শুনতে পান না। যদিও তারা দুজনেই ভালো করে জানেন যে তাদের মনের গর্তের ভেতরে এ রকম একটা সাপ পেঁচিয়ে আছে। কিন্তু তারা এই সাপকে কখনো খোঁচা দেন না, এই ভয়ে, যদি সে ফোঁস করে জেগে ওঠে।

মইন আলীর নিজের মনটাও তখন একটু খারাপ হয়ে গেল। কী হবে যদি দেখেন যে আসলে তার নিজের শুক্রাণুই এই সবকিছুর মূল কারণ! আর যদি ফওজিয়ার সমস্যাও হয়, তখনই-বা কী করবেন তিনি। তার বুকের ভেতরে এ রকম কিছু প্রশ্ন নিজের অজান্তেই লাউয়ের ডগার মতো লকলক করে বাড়তে থাকে। ফওজিয়ার বুকেও কি এ রকম প্রশ্ন জমে আছে? তারা দুজনেই তো জানেন, বুকের ভেতরে বেড়ে ওঠা এসব গোপন প্রশ্ন হচ্ছে আগাছার মতো। সময়মতো উপড়ে না ফেললে ওরা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়বে যে শেষ পর্যন্ত তাদের নিশ্বাসও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

মইন আলী দেখেছেন, ফওজিয়া আজকাল একা একা থাকতেই পছন্দ করেন বেশি। আজ কত বছর হয়ে গেল ওদের বিয়ে হয়েছে, কিন্তু মাঝেসাঝে মইনেরই ওকে চিনতে অসুবিধা হয়। আগে যে মানুষটা ঘরভর্তি মানুষ নিয়ে হইহুল্লোড়ে মেতে থাকত, সে কিনা এখন ঘরের ছিটকিনি লাগিয়ে ওপাশের বারান্দায় চুপচাপ বসে দূরের বাড়িঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

এ জন্য মইন একদিন তার স্ত্রীকে রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘জয়া, তুমি তো একটা চড়ুই পাখির মতো চঞ্চল ছিলে একসময়, কিন্তু হঠাৎ এমন শামুক হয়ে গেলে কেন?’ এই কথায় ফওজিয়া রাগ করেন না, আবার খুশিও হন না। ফওজিয়ার হুট করে এই জীবন বেছে নেওয়ার পেছনে যে কারণ, সেটা এই পৃথিবীতে একমাত্র তিনিই জানেন।

খোঁটা দিয়েও নিজের স্ত্রীকে যখন উত্তেজিত করতে পারেন না, তখন মইন আলী নিজেও একবার ভাবেন যে তার জীবনটাও যদি এ রকম শামুকের মতো হতো, তাহলে খুব একটা মন্দ হতো না। ইদানীং তার নিজেরও মনে হয় যে জীবনটা অনেক বেশি জটিল আর ঘোলাটে হয়ে গেছে। কীভাবে কীভাবে যে এমন হয়ে গেল, সেটা তিনি নিজেও বুঝতে পারেন না।

একটার পর একটা ঘটনা তাকে আজ এত দূর নিয়ে এসেছে। তার জীবন শুরুতে এ রকম ছিল না। হুট করেই কোনো একটা ঘটনা থেকে শুরু হয়েছে তার এই নতুন জীবন। শিকলের একটা রিং যেমন আরেকটা রিংকে পেঁচিয়ে নিজে টিকে থাকে, তেমনি তার জীবনেরও একটা ঘটনা, আরেকটা ঘটনাকে আঁকড়ে ধরে তাকে টিকিয়ে রেখেছে। এই জট খোলার এখন আর কোনো উপায় দেখছেন না তিনি। মইন আলীর কখনো কখনো মনে হয় শিকল ভেঙে একদিন ঠিক ঠিক এই জীবন থেকে নিঃশব্দে পালিয়ে যাবেন তিনি। কিন্তু ভয় পান। সে এক ভয়ানক ভয়।

এই ভয় বর্ণনা করার ভাষা তার নেই। শুধু তা-ই নয়, এই ভয়ের কথা শেয়ার করারও কোনো মানুষ নেই তার জীবনে। এমনকি ফওজিয়াও না। কোনো কোনো রাতে ভয়ের চোটে ঘুম ভেঙে যায় মইনের। অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন তিনি। একদিন দেখলেন একদল লোক তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের ভেতরে। তার হাত দুটো পিঠমোড়া করে বাঁধা। তাকে বলা হলো দৌড়াতে কিন্তু তিনি দৌড়াতে পারছেন না। তার পা ভেঙে যাচ্ছে। আরেক রাতে দেখলেন তার মৃতদেহ পড়ে আছে জলমগ্ন ধানখেতের ভেতরে। তখন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে শিয়ালের ডাক। ওই ডাকে স্বপ্ন ভেঙে গেলে বিছানায় উঠে বসে থাকেন তিনি। দেয়ালের এক পাশে জানালার ওপরে হিশ হিশ করে এসি চলছে, কিন্তু তারপরও ঘামে ভিজে যায় তার শরীর। ফওজিয়াকে ডেকে তোলারও সাহস পান না। ডেকে কী বলবেন তাকে? কখনো কখনো এমনও রাত গেছে যে মইন আলী বিছানা ছেড়ে ঘর থেকে উঠে গিয়ে বসে থেকেছেন সিটিং রুমের সোফায়, কিংবা বেডরুম লাগোয়া ছোট্ট বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। রাতের আকাশে দেখেছেন ভেসে যাওয়া কালো মেঘ, তার ভেতরেও ওত পেতে ছিল ভয়। হঠাৎ একখণ্ড মেঘকে তার মনে হলো চিত হয়ে পড়ে থাকা একটা লাশ, সেখানে চাঁদের আলো এমনভাবে পড়েছে যেন গড়িয়ে পড়ছে রক্তের স্রোত। ইঁদুরের মতো ছুটে পালিয়ে এলেন ঘরের ভেতরে। আরও একটা রাত নির্ঘুম কাটল মইন আলীর।

রেস্তোরাঁর রেডিওতে তখন কী একটা অনুষ্ঠান চলছে। শোনো, স্বামীকে ডাকেন ফওজিয়া। বললেন,‘খুব বেশি কিছু অর্ডার দিয়ো না।’

‘কী খেতে চাও?’
‘এনিথিং, তুমি পছন্দমতো বলে দাও।’
এখানে মইন কয়েক বিঘা জমি কেনার পরিকল্পনা করছেন। কিছু জায়গা দেখেও রেখেছেন। মনে মনে সিদ্ধান্তও নিয়ে নিয়েছেন কেনার। কিন্তু ফওজিয়াকে দেখানো তো দূরের কথা, এ নিয়ে তাকে কিছু বলাও হয়নি। মইন ভেবে রেখেছেন, আজ এখানে বসে, খেতে খেতে জমি কেনার পরিকল্পনার কথাটা তিনি তার স্ত্রীকে জানাবেন।

শিমভর্তা, ডালভর্তা, লাউ দিয়ে মাগুর মাছের ঝোলের মতো একটা তরকারি, দুই বাটি চিকেন আর দুই প্লেট ভাত দেওয়ার কথা বললেন মইন আলী। দেখলেন কিছু মাছি বড় বড় খাবারের ডালাগুলোর ওপর ভনভন করে উড়ছে। দেখে একটু ইতস্তত করলেন তিনি। একটা ছোট ছেলে বসেছিল খাবারগুলোর ওপাশে। সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালেন মইন। বললেন, ‘এই, এগুলো কবের তরকারি?’

‘ছার, আইজকাই রানছে’, ছেলেটি তড়িঘড়ি করে উত্তর দিল।
‘মাছি ক্যান এত? খাবার ঢাইকা রাখতে পারস না?’
ছেলেটি মাথা নিচু করে বসে রইল। কোনো উত্তর দেওয়ার সাহস নেই ওর। দূরে বড় বড় পাত্রে খাবার গোছগাছ করছিল মধ্যবয়সী এক লোক, দোকানের ম্যানেজার।

মইন আলী কার কাছ থেকে জমি নেবেন, সেটা মোটামুটি ঠিকই হয়ে আছে। তারই এক বন্ধু, যে এখন পুলিশে আছে, ওই লোকের খোঁজ দিয়েছে তাকে। দুই বিঘার বেশি হবে। কথা মোটামুটি ফাইনাল। জমির মালিক কয়েক মাস ধরে আছে জেলখানায়। প্রথমে তার নামে কয়েকটা কেস দেওয়া হয়েছে। তারপর হয়েছে আপসরফা। এখন শুধু জামিনের জন্য অপেক্ষা। ওটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলেই জমির রেজিস্ট্রেশন।

খেতে খেতে মইন তার স্ত্রীকে জমির কথাটা বললেন। ফওজিয়া প্রথমে একটু আপত্তি তুলেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন দুই বিঘা জমি কেনার টাকা তিনি পাবেন কোথায়। ঢাকা শহর এখন যত দ্রুতগতিতে বাড়ছে, আর জমির যে চাহিদা তাতে এখনকার দুই বিঘার দাম কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ‘তুমি ওসব নিয়ে ভেবো না জয়া। ম্যানেজ হয়ে যাবে,’ এইটুকু বলে মাছের একটা কাঁটা দাঁত দিয়ে চেপে মইন তাকালেন ফওজিয়ার চোখের দিকে। কিন্তু পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে নিলেন। পারলেন না তাকিয়ে থাকতে। দেখলেন ফওজিয়ার চোখে অবিশ্বাস স্পষ্ট।

মইন আলী আর স্ত্রীকে সবকিছু বলেননি। কারণ, ঘটনাপ্রবাহে জীবনের যে পঙ্কিলতায় তিনি ডুবে গেছেন, সেটা তিনি নিজের কাছেও গোপন রাখতে চান। তবে তিনি এটাও জানেন, এখন যে পদে তিনি আছেন, সেটা তার জীবনে আলাদিনের চেরাগের মতো। এই চেরাগ সব সময় পাওয়া যায় না। ফলে যা ঘষা দেওয়ার, সেটা দিতে হবে এখনই। পরে দিন-রাত চেরাগ ঘষলেও এই দৈত্য আর কখনো আসবে না।

ফওজিয়া জানেন না যে এই দৈত্যই এর মধ্যে ঢাকায় তাদের দুটো ফ্ল্যাট এনে দিয়েছে। সেগুনবাগিচার অ্যাপার্টমেন্টের কথা শুধু ফওজিয়া জানেন। তাকে বলতে হয়েছিল কারণ দৈত্যটা মইনকে বলেছে ওই ফ্ল্যাট তার স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রেশন করাতে। দৈত্যটা গাজীপুরেও তাকে দুই একর জমি জোগাড় করে দিয়েছে, সেটাও জানেন না তিনি। আর এখন তো তার স্বামীর হাতে এনে দিয়েছে এই কেসটাও। তার জের ধরে যে জমিটা একেবারে হাতের নাগালের কাছে, তার কথা আজই মইন আলী একটু একটু করে তার স্ত্রীকে বলতে শুরু করেছেন।

‘জয়া,’ খেতে খেতে মুখ তুলে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মইন বলতে লাগলেন, ‘এখানে যে জমিটা হবে সেটা তোমার নামেই করে দিই, কী বলো?’ স্ত্রীর উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি বলতে লাগলেন, ‘আমার নামে হলে যদি পরে ঝামেলা হয়। যদি এটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে। শুরু থেকেই সবকিছু গুছিয়ে রাখা ভালো।’

এবারও কিছু বললেন না ফওজিয়া। বরং বলতে থাকলেন মইন, ‘কয়েক মাসের মধ্যেই সব ফাইনাল হয়ে যাবে। তোমাকে বেশি কিছু করতে হবে না। একটা কাগজে সই করতে হবে শুধু। আর একদিন রেজিস্ট্রেশনের জন্য তোমাকে ভূমি অফিসে নিয়ে যাব, ব্যস, এতটুকুই।’

কথা বলতে বলতে মইন আলী দেখলেন, ফওজিয়ার বাঁ পাশে একটা লোক এসে বসেছে। বয়সে তরুণ। গায়ের জামাকাপড়ও খুব একটা পরিষ্কার নয়। রুক্ষ মুখ। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মইন একবার লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলেন। কিন্তু কেমন খচখচ করে উঠল তার মনের ভেতরে। লোকটাকে চেনা চেনা মনে হলো তার। কিন্তু মনে করতে পারলেন না, কে এই তরুণ। এ জন্য তার একটু অস্বস্তি হলো। লোকটার ওপর থেকে মনোযোগ অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে চাইলেন তিনি। ফওজিয়াই তখন তার সাহায্যে এগিয়ে এলেন, ‘এত কিছু দিয়ে তুমি কী করবে মইন?’

‘কী যে বলো না জয়া, এত কিছু কই দেখলা তুমি?’
‘এই যে ফ্ল্যাট, জমিজমা এসব দিয়ে কী করবা?’
‘কেন বলো তো, তুমি মনে হয় অনেক বড়লোক হয়ে গেছ? আমি ভাই গরিব মানুষ। অনেক সংগ্রাম করে এখানে এসেছি। আমাদের পরিবারের কথা তুমি জানো। তোমাকে বলেছি কেমন ছিল আমার ছোটবেলা। এখন যদি একটা কিছু করতে চাই, তাহলে কি সেটা দোষের?’

‘আমি তো তোমাকে কোনো দোষ দিইনি মইন। শুধু বলেছি, এত কিছু দিয়ে করবেটা কী! আমাদের তো আর কেউ নেই। তুমি আমি ছাড়া।’
ধক করে উঠল মইন আলীর বুকের ভেতরে। মনে হলো তার স্ত্রী তাকে খোঁচা দিচ্ছে। কেউ নেই মানে তো সন্তান না হওয়া। ফওজিয়া বুঝি পরোক্ষভাবে বলতে চাইছে তাকে সন্তান দেওয়ার কোনো ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু কীভাবে? সেটা তো তারা জানেন না এখনো। আর এখন কেউ নেই মানে তো এই নয় যে ভবিষ্যতেও তাদের কেউ হবে না। জীবন তো শেষ হয়ে যায়নি মোটেও।
এর কয়েক দিন পর, তারা বসেছিলেন বারান্দায়, পাশাপাশি দুটো বেতের চেয়ারে। খুব ভেঙে পড়েছিলেন ফওজিয়া। কাঁদতে কাঁদতে ফওজিয়া মইনকে বলেছিলেন, ‘চলো, আমরা এখান থেকে চলে যাই। তুমি অন্য কিছু করো মইন।’

‘কেন, এখানে কী অসুবিধা হচ্ছে তোমার, বলো?’
‘জানি না, আমার ভালো লাগছে না। শ্বাস নিতে পারি না।’
‘কী যে ছেলেমানুষি করো তুমি জয়া!’
ফওজিয়া তখন তার স্বামীকে পুরো বিষয়টা খুলে বলার প্রস্তুতি নিলেন। উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার থেকে। এক পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। কয়েক মাস আগে ওখানে একটা টবে লেবুগাছ লাগিয়েছিলেন ফওজিয়া। গাছটা এখন বেশ বড় হয়েছে। ফুল ধরেছে কিছু। তার হালকা একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।

‘মিরপুরের সুমন কোথায় আছে তুমি কি জানো, মইন?’
‘হু ইজ সুমন?’
‘যে ছেলেটা বাড়ি থেকে হঠাৎ গুম হয়ে গেল। ওর মা বলছে, সাদাপোশাকের একদল লোক ওকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ বলছে ওরা কিচ্ছু জানে না।’ ফওজিয়ার গলা এখন ভারী।
‘আমি কীভাবে জানব জয়া? আমি কি তোমাদের মতো সাংবাদিক নাকি?’ খুব দ্রুত উত্তর দিলেন মইন আলী।
‘সাংবাদিকেরা যা জানে না তোমরা পলিটিশিয়ানরা সেটা জানো, মইন।’
‘জয়া, তোমার এসব কথার কোনো মানে বুঝতে পারছি না।’

এরপর তিনি ‘এসব কথার’ অর্থ বোঝাতে পুরো ঘটনা খুলে বললেন তার স্বামীকে। ‘তুমি কি জানো আমি কেন চাকরি ছেড়ে দিয়েছি? জানো না। আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি কারণ যে খবর আমি ছেপেছি, সেটা আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিন্তু বিশ্বাস না করেও উপায় ছিল না। আমি নিজে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে খোঁজ নিয়েছিলাম। অনেক জায়গা থেকেই তোমার নামটা বলা হয়েছে। আমাদের রিপোর্টার যে খবর দিয়েছে, তাতে আরও কয়েকটা নামের সঙ্গে তোমার নামও ছিল মইন। রাস্তা পরিষ্কার রাখতে তোমরা ওকে সরিয়ে দিয়েছ।’

এটুকু বলে ফওজিয়া আকাশের দিকে তাকালেন। পরিষ্কার নীল আকাশ ছিল একটু আগেও। কিন্তু এখন সেখানে ভিড় করেছে ছাইরঙা কিছু মেঘ। মইন দেখলেন, একটা মেঘ আরেকটা মেঘের ভেতরে এমনভাবে ঢুকে গেছে, মনে হচ্ছে অন্তঃসত্ত্বা এক নারী পরির মতো উড়ে যাচ্ছে আকাশে।

‘মইন, তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও।’
‘কী বলছ তুমি!’
‘আমি যা বলছি, সেটা খুব পরিষ্কার এবং সহজ। ইউ শুড লিভ পলিটিকস।’
‘চাইলেই ছাড়া যায় না জয়া। এটা আমার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে।’
‘চেষ্টা করে দেখো, না পারলে চলো আমরা বিদেশে চলে যাই।’

মইন আলী চেয়ার থেকে উঠে এসে ফওজিয়ার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। দুহাতে আঁজলা করে ধরার চেষ্টা করলেন তার মুখ। ফওজিয়া তার ডান হাত দিয়ে একঝটকায় ঠেলে সরিয়ে দিলেন মইনের হাত। ‘তুমি যা শুনেছ সব মিথ্যা জয়া। সব মিথ্যা। বিশ্বাস করো তুমি। প্লিজ, বিশ্বাস করো,’ বলতে বলতে আরও সামনের দিকে এগিয়ে ফওজিয়াকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। ফওজিয়া তখন আছড়ে পড়েছে তার স্বামীর বুকের ওপর। মইন টের পেলেন ফওজিয়ার কান্নার দমকে তার শরীরটাও কাঁপছে। শুনতে পেলেন আকাশে তখন থেমে থেমে গুলি হওয়ার মতো গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছে।

রেস্তোরাঁয় ফওজিয়ার পাশে বসা লোকটার দিকে আবারও তাকালেন মইন আলী। ভাবলেন কোথায় দেখেছেন তাকে। ভেবে ভেবে ভেতরটা প্রচণ্ড অস্থির হয়ে গেল তার। মাথায় যখন একটা কিছু ঢোকে, সেটা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নিস্তার নেই তার। মইন তখন খাওয়ায় মনোযোগ দিতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। নিজের অজান্তেই বারবার তার চোখ চলে যাচ্ছে ওই তরুণের মুখের ওপর। যতবারই তিনি তার দিকে তাকিয়েছেন ততবারই দেখেছেন যে সে-ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মইনই চোখ নামিয়ে নিয়েছেন প্রতিবার।

কোথায় দেখেছেন তাকে, কোথায়, কোন জায়গায়, কে এই তরুণ? কার মতো এই এক জোড়া চোখ? এর আগে তো কোনো মানুষ তাকে এভাবে টানেনি কখনো, কিন্তু একটু আগে উড়ে এসে জুড়ে বসা এই লোকটি যেভাবে বারবার তার দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে, মনে হচ্ছে সে-ই তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু সেই চোখের দিকে তাকাতেও অসুবিধা হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে, অচেনা ওই যুবকের চাহনিতে হাজার হাজার তির। আর সেগুলো তীব্রগতিতে ছুটে আসছে তার দিকে।

মইন আলীর মনে পড়ল তিন বছর আগের এক রাতের কথা। একটা ফোন পেয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন তিনি। তাকে খবর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। প্রথমে বলা হয়েছিল, শুধু থানায় গেলেই চলবে। একজন ‘সন্ত্রাসীর’ নাম-পরিচয় নিশ্চিত করেই ফিরে আসবেন তিনি। কিন্তু পরে ঘটনা মোড় নিল অন্যদিকে। তখন কোনো কিছুর ওপরেই নিয়ন্ত্রণ রইল না মইনের। তাকেও যেতে হয়েছিল পুলিশের সঙ্গে। অমাবস্যার রাত ছিল সেদিন। দুটো দলে বের হয়েছিল তারা। দুটো গাড়িতে ছিল তাদের দল। সামনেরটাতে ছিলেন মইন, এসআই জমির এবং আরও তিন–চারজন পুলিশ। একজন তরুণ ছিল তাদের সঙ্গে। নাম: হামিদুল ইসলাম। ওর নামে তেজগাঁও থানায় একটা মার্ডার কেস দেওয়া হয়েছিল প্রথমে। তারপর বহু খোঁজাখুঁজি করে মাত্র দুদিন আগে তাকে পাওয়া গিয়েছিল মগবাজারের একটা আবাসিক হোটেলে। হাতে পাওয়ার পর তাকে আর আদালতে তোলা হয়নি। দুই রাতই সে ছিল থানার গারদে।

তাকে এই হামিদুলের কথা বলেছিলেন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী সাজ্জাদ হোসেন। এর কয়েক দিন আগে তার কিছু কাজ করে দিয়েছিলেন মইন আলী। তিতাসের অফিসারদের বড় অঙ্কের ঘুষ দিয়ে তার কারখানায় লাগিয়ে দিয়েছিলেন গ্যাসের কানেকশন। ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সোনালী ব্যাংক থেকে ৫ কোটি টাকা লোনেরও। সে সময় কিছু টাকা নিজের পকেটেও ঢুকিয়েছিলেন মইন। সাজ্জাদ সাহেবই তাকে টাকাটা দিয়েছিলেন। এভাবে-সেভাবে তাদের মধ্যে একটা ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে। ঠিক বন্ধুত্ব নয়, আসলে গড়ে উঠেছিল ব্যবসায়িক সম্পর্ক। একদিন সচিবালয়ে মন্ত্রীর অফিসে দেখা করার পর তারা যখন ফিরছিলেন, সাজ্জাদ সাহেবই মইনকে লিফট দিতে চাইলেন। হিমশীতল ফোর হুইল এসইউভির ভেতরে বসে সেদিন কথা হয়েছিল তাদের।

‘আমি একটা বড় ঝামেলায় পড়েছি ভাই।’
‘আরে ভাই, আপনার তো দেখি সমস্যার শেষ নাই।’ শাহবাগের কাছে যানজটে আটকে ছিল তাদের গাড়ি।
‘আসেন এই ব্যবসায়, তখন বুঝবেন,’ সাজ্জাদ সাহেবের মুখে হাসি।
‘না ভাই, আমারে দিয়ে ওটা হবে না। বলেন দেখি কিসের সমস্যা?’ জানতে চাইলেন মইন আলী।
‘ভাই, চাঁদাবাজির জন্য ব্যবসা করা আজকাল খুব কঠিন। প্রত্যেক মাসে চায়। প্রথমে চায় পঞ্চাশ হাজার। তারপর দাবি করে এক লাখ। আমি তো আর টাকার আড়ত নিয়া বসি নাই।’
তখনই হামিদুলের কথা বলেছিলেন সাজ্জাদ সাহেব। বলেছিলেন, ‘একটা কিছু করেন ভাই। যা লাগে আমি সব দিব।’

ওই হামিদুলের সঙ্গে কি এই তরুণের চেহারার মিল আছে? কিন্তু কীভাবে সম্ভব! সে তো...ভাবনার চোরাবালিতে মইন একটু একটু করে ডুবে যেতে লাগলেন। মনে হলো তার পায়ের তলা থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে মাটি। যেকোনোভাবেই হোক তাকে এখন শক্ত কিছুর ওপর দাঁড়াতে হবে। পা দুটো নেড়েচেড়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন তিনি, যেকোনো কিছু, তার নাম, পরিচয়, ঠিকানা যা কিছু পাওয়া যায়। তিনি চেষ্টা করতে লাগলেন ওই রাতে যে ‘সন্ত্রাসীকে’ সঙ্গে নিয়ে তারা অপারেশনে বের হয়েছিলেন, তার মুখটা মনে করতে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলেন ন। চোখ দুটো মনে পড়ছে তো নাকটা মনে হচ্ছে অন্য রকম, চুল তো কোঁকড়ানো ছিল, কিন্তু এর তো মাথায় চুলই নেই, ন্যাড়া। তাহলে? তার মনে পড়ল, ওই যুবকের নাম ছিল হামিদুল ইসলাম ওরফে মনির ওরফে কাইল্লা মনির। ওর গায়ের রংও কি এই লোকটার মতো কালো ছিল? কে জানে! রাতের অন্ধকারে ঠিকমতো দেখাও হয়নি।

‘এই যে ভাই, আপনার নাম কী?’ জিজ্ঞেস করলেন মইন আলী।
লোকটা কোনো জবাব দিল না। কিন্তু তার চোখে-মুখে তখনো লেগে আছে সেই একই হাসি।
‘হাসেন ক্যান? আপনার নাম জিজ্ঞেস করলাম না?’ অস্থির হয়ে পড়লেন মইন। কিন্তু লোকটা তখনো নির্বিকার।
ফওজিয়া দেখলেন তার স্বামী উত্তর না পেয়ে রাগে ফুঁসছে। তার চোখে-মুখেও সেটা স্পষ্ট। প্রশ্ন করলে উত্তর না পাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই মইনের। ফওজিয়া তা জানেন, এটা তিনি তার সংসারেও দেখেছেন।

মইন আলীর মনে পড়ল, ওই রাতে জিপটা নিয়ে তারা মূল সড়ক থেকে নেমে গিয়েছিলে একটা বিরানখেতের ভেতরে। তারপর সোজা গিয়েছিল আরও দশ মিনিট। জিপের ভেতরে চুপ করে বসে ছিল কাইল্লা মনির। নড়াচড়াও করেনি। তার হাত দুটো পিঠমোড়া করে বাঁধা ছিল। খালি গা। ছুরি দিয়ে কাটা লম্বা একটা দাগ ছিল বুকের ওপরে। সেলাইয়ের দাগটা দেখে চমকে উঠেছিলেন মইন। বুঝতে পেরেছিলেন বুকের বেশ ভেতরেই ঢুকে গিয়েছিল ছুরিটা। তারপরও সে কীভাবে বেঁচে গিয়েছিল একমাত্র আল্লাহই জানেন!

খাবার রেখে উঠে দাঁড়িয়েছেন মইন আলী। সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন ওই তরুণের সামনে। ‘এই শালা, তোর নাম জিগাইছি?’কোনো উত্তর এল না এই প্রশ্নেরও। বরং এল আরও এক দফা হাসি। চট করে রক্ত উঠে গেল তার মাথায়। মইন ততক্ষণে লোকটার কলার চেপে ধরেছেন। ফওজিয়া অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন এ রকম আকস্মিক ঘটনায়। দ্রুত এগিয়ে গেলেন সামনে। আশপাশের লোকজনও ত্রস্তব্যস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু কেউ এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেল না।

‘করছ কী তুমি, ছাড়ো।’ ফওজিয়ার অনুরোধ।
‘দেখেছ তুমি, কত বড় বেয়াদব? কয়বার জিজ্ঞেস করলাম নামটা, তুমিই বলো জয়া? জবাব দেয় না, শুধু হাসে। শালা দেখাচ্ছি মজা।’ ষাঁড়ের মতো ফুঁসে উঠলেন মইন আলী। তারপর বলতে লাগলেন, ‘শুয়োরের বাচ্চা, তুই চিনস আমারে? কে আমি, জানস?’

ফওজিয়া তার স্বামীকে টেনে নিয়ে গেলেন লোকটার কাছ থেকে। গ্লাসের পানি ঢেলে হাতটা ধুইয়ে দিলেন তার। তারপর শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে স্বামীর হাত ধরে টানতে লাগলেন। তরকারির হলুদ দাগ তখনো লেগে আছে মইনের আঙুলের ফাঁকে। ‘তুমি যে কী করো না মইন! বেশি বেশি!’
স্বামীকে শাসালেন ফওজিয়া, ‘কোথায় কার সঙ্গে কী করতে হবে, সেটাও বুঝতে পারো না।’
হাত ধরে একটু দূরে টেনে নিয়ে গিয়ে আরেকটা টুলে বসিয়ে দিলেন স্বামীকে। ফওজিয়াও তার সামনে বসে চারদিকে তাকালেন। দেখলেন সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

মইন আলী চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করলেন, ওই রাতে এরপর কী কী হয়েছিল। কাইল্লা মনিরকে তারা নিয়ে গিয়েছিল একটা বিলের ধারে। তারপর খুলে দিয়েছিল হাতের বাঁধন। চারপাশে ঝিঁঝি পোকার ডাক অসহ্য লাগছিল তার। মনে হচ্ছিল পোকাগুলো তার কানের সামনে জড়ো হয়ে চিৎকার করছে। সেই ডাক গিয়ে লাগছিল তার মগজের ভেতরে। ওই রাতে খুব বেশি দেরি করতে চাননি মইন। এত দূরে আসারও কথা ছিল না তার। কথা ছিল শুধু হামিদুলকে শনাক্ত করেই তিনি ফিরে যাবেন বাড়িতে। কিন্তু কী থেকে যে কী হয়ে গেল। একসময় তিনিও উঠে পড়লেন পুলিশের গাড়িতে। তার মনে আছে, কাইল্লা মনির এসআই জমিরকে শুধু বলছিল, ‘ছার, আমারে মাইরেন না ছার। আমারে কোর্টে দ্যান। জেলে দ্যান। আমারে মাইরেন না ছার।’

হামিদুলের ওই কাকুতি–মিনতি চাপা পড়ে গিয়েছিল ঝিঁঝি পোকার কুৎসিত ডাকের আড়ালে।
তারপর মনিরের হাত দুটো খুলে বলা হয়েছিল দৌড় দিতে। সে দৌড়ায়নি তখনো। বরং দাঁড়িয়ে ছিল ওদের সামনেই। এক ফাঁকে বসে পড়েছিল মাটিতে। মইন আর এসআই জমিরের পা-ও জড়িয়ে ধরেছিল কয়েকবার। কিন্তু তাকে মাটি থেকে উঠিয়ে ধমকের সুরে বলা হয়েছিল দৌড় দিতে। ‘শুয়োরের বাচ্চা দৌড়া...এইখান থাইক্কা...পালা, খানকির পোলা।’
‘ছার, আমারে মাইরেন না ছার,’ কাঁদতে লাগল হামিদুল। এসআই জমির তখন তার পাছায় একটা লাথি দিলে সে কাদার মধ্যে উল্টো হয়ে পড়ে গেল। ‘চুতমারানির পোলা দৌড়া। নাইলে মরবি। যা ভাগ।’

হামিদুল তখন দিল দৌড়। বিলের পাড় ধরে ছিল সেই দৌড়। নরম মাটির ভেতরে বসে যাচ্ছিল হামিদুলের পা। দৌড়াতে পারছিল না ঠিকমতো। একবার দুবার পড়ে গিয়ে সে কোনোরকমে উঠে আবারও দৌড়াতে শুরু করল।

এর কিছুক্ষণ পরেই একটা গুলির আওয়াজ হলো। তারপর আরও একটা। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে শোনা গেল আরও একটা আওয়াজ। মোট তিনটা। গুলির আওয়াজ বিলের ওপারের কয়েকটা বাড়িঘরে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল মইনের কানে। সে সময় ভয়ে চুপ করে গিয়েছিল সব ঝিঁঝি পোকাও। রাতের সেই নিস্তব্ধতা কাচের গ্লাসের মতো চুরমার করে ভেঙে দিয়ে এলোপাতাড়ি বেজে উঠল এস আই জমিরের হুইসেল।

‘এই তোরা লাশ ওঠা।’
‘খাতায় কী লিখমু স্যার,’ একজন জানতে চাইল। এসআই জমির তখন টর্চলাইটটা ধরে রেখেছে পুলিশের রেকর্ডবুকের ওপর। আর সেখানে খস খস করে লেখা হলো—একটা পিস্তল, এক ডজন বিচি আর ৫০টা ইয়াবা।

‘তিনটা খোসা পাস কি না দেখ,’ বললেন এসআই জমির।

মইন আলীর মনে হলো, এই তরুণই কি ওই রাতের হামিদুল ওরফে কাইল্লা মনির? তার সঙ্গে তো তিনি এখন অনেক কিছুরই মিল পাচ্ছেন। মনে হচ্ছে ওদের গায়ের রং এক, চোখটাও তার চোখের মতো। ওই রাতে সে যখন ‘আমারে মাইরেন না, ছার আমারে মাইরেন না’ বলে জীবন ভিক্ষা চাইছিল, তখন তার চোখ দুটোও এই যুবকের চোখের মতোই লাগছিল। একই রকমের উজ্জ্বল আর একই রকমের জলে টলমল দুটো চোখ। কিন্তু সেটা তো কিছুতেই সম্ভব নয়। পোস্টমর্টেমের পর ওর লাশ তুলে দেওয়া হয়েছিল আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে। ওরা তাকে কবর দিয়েছে আজিমপুর কবরস্থানে।

আরেকবার নিশ্চিত হতে মইন আলী তাকালেন ওই তরুণের দিকে। দেখলেন তার চোখ দুটো লাল। রক্তজবার মতো। তার মনে পড়ল হামিদুলের ভয়ার্ত মুখ। কিন্তু এই তরুণের মুখেও সেই একই হাসি। মইনের মনে হলো, সে তাকে ব্যঙ্গ করছে। মাথায় চড়াৎ করে আবার রক্ত উঠে গেল তার। মুহূর্তে ছুটে গেলেন ওই তরুণের কাছে। ঠাস ঠাস করে দুটো চড় মারলেন দুই গালে। হোটেলের ম্যানেজার দৌড়ে গিয়ে মইনের হাত থেকে ওই তরুণকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল।

‘কী করেন ছার, ছাড়েন ওরে,’ ম্যানেজার অনুরোধ করল।
‘আপনেরা দেখেছেন, কেমন বেয়াদব পোলা। কতবার নাম জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু কিছুই বলে না।’
ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন লোক এগিয়ে গেল ওদের সামনে। সবাই মিলে লোকটিকে মইন আলীর থাবা থেকে ছাড়িয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ফওজিয়া দেখলেন, ধস্তাধস্তিতে তরুণের শার্টের সামনের দিকে ওপরের সব কটি বোতাম ছিঁড়ে গেছে।

‘ছার, হেয় তো বোবা, কথা কইতে পারে না।’
উত্তেজনা আর হই–হট্টগোলের মধ্যে মইন আলী দূর থেকে ম্যানেজারের এই কথাটা ঠিকমতো শুনলেন কি না বোঝা গেল না। কিন্তু তিনি দেখতে পেলেন, তরুণের শার্টটা যেখানে ছিঁড়েছে, সেখানে—ঠিক বুকের মাঝখানে, ছুরি দিয়ে বসানো একটা লম্বা কাটা দাগ। সেলাই দেখেও বোঝা যায় বুকের ওই ক্ষত কতটা গভীর ছিল।