ব্যাংকের চাকরি কেন লোভনীয়?
বিগত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার-ভাবনা নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। এগুলোয় আমি ‘মাল্টিপল ক্যারিয়ার চয়েজ: প্ল্যান অ্যান্ড প্রিপারেশন’ বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা করেছি। শুরুতেই তাঁদের চারটি ‘ক্যারিয়ার অপশন’ দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম তাঁদের মতামত। সরকারি চাকরি (পাবলিক সার্ভিস), ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, করপোরেট ক্যারিয়ার এবং শিক্ষকতা ও গবেষণা—এই চারটির মধ্যে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী মোটাদাগে সরকারি চাকরির কথা বললেও তাঁদের পছন্দের শীর্ষে ব্যাংকিং ক্যারিয়ার। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় প্রতিবছরই নিয়মিত নিয়োগ কার্যক্রম চলছে। এ ছাড়া অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয়ও রয়েছে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কাঙ্ক্ষিত ক্যারিয়ার গড়তেই উচ্চশিক্ষিতদের ঝোঁক।
কেন ব্যাংকিং ক্যারিয়ারের দিকে ঝোঁক? এ প্রশ্নেরও উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে। যেকোনো বিষয়ে পড়াশোনা করে ব্যাংকগুলোয় দ্রুত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগের সুযোগ, উচ্চ বেতন ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা, দীর্ঘমেয়াদি ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগসহ ব্যাংকারদের সুশৃঙ্খল পরিপাটি জীবন তাঁদের প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। এ জন্য গত এক দশকে আমাদের দেশের বেকারত্বের হার মোটামুটি ৪ থেকে ৫ শতাংশর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষায় চাকরি প্রার্থীর সংখ্যা বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। শুধু ব্যাংকিং, ফিন্যান্স, ব্যবস্থাপনা, অর্থনীতি বা ব্যবসায়সংক্রান্ত বিষয়ই নয়, বিজ্ঞান, কৃষি প্রকৌশলসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত বিষয়ে ডিগ্রিধারীরা ক্রমেই ঝুঁকে পড়ছেন ব্যাংকের দিকে।
বলতে দ্বিধা নেই, আমিও ফার্মেসিতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে কিছুদিন বেসরকারি চাকরিতে থাকলেও শেষমেশ সেখানে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি নিয়েছি। এ রকম অনেকেই বিভিন্ন বিশেষায়িত বিষয়ে পড়াশোনা করে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরি করে আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগ দিয়েছে। যেমন আমাদের পরবর্তী ব্যাচের সহকারী পরিচালক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন কৃষিপ্রযুক্তি বিষয়ে স্নাতকোত্তর একজন শিক্ষার্থী। আবার সে বছর ব্যাচের অফিসার নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন একজন ফার্মেসি গ্র্যাজুয়েট। আর বিগত কয়েক বছরে নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের অধিকাংশই কৃষি, বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিতে স্নাতক–স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। শুধু নিয়োগ পরীক্ষায় না, পেশাগত জীবনেও অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা ভালো করছেন; উচ্চপদে আসীন হচ্ছেন। পড়াশোনার বিষয় ভিন্ন হওয়ার কারণে শুরুতে একটু সমস্যা হলেও তা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে না। কারণ, এখান থেকে দেশ–বিদেশে পেশা-সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ ও পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে।
যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক পদে স্থায়ী হওয়ার পর ব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (এমবিএম), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে মাস্টার্স এবং আইবিতে এক্সিকিউটিভ এমবিএ করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া দেশের বাইরে বিভিন্ন সংস্থার বৃত্তির আওতায় থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, যুক্তরাষ্ট্রের উলিয়ামস কলেজ এবং জাপান অস্ট্রেলিয়া ও চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেষণে মাস্টার্স করার সুযোগ রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যেহেতু তথাকথিত ব্যাংকিং সেবা দিতে হয় না, বরং সামগ্রিক অর্থনীতি, উন্নয়ন ও ব্যাংকিং খাতের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে যুক্ত থাকতে হয়, ফলে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা পেশাগত উৎকর্ষ সাধনে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
ব্যাংকে চাকরির প্রস্তুতিকথা
ডিসেম্বরের শুরুতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এতে যেকোনো বিষয়ে ন্যূনতম স্নাতকসম্পন্ন (কমপক্ষে দুটি প্রথম শ্রেণিসহ) যেকেউ আবেদন করতে পারবেন। প্রস্তুতি ভালো থাকলে নিয়োগ পরীক্ষার পার হওয়া সহজ হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আবেদনের পরই প্রস্তুতি শুরু করব ভেবে বসে থাকলে আশায় গুড়ে বালি হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি পেতে দরকার হয় দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি, বিস্তর পড়াশোনা। জেনেশুনে গুছিয়ে নিয়মমাফিক পড়াশোনা করতে পারলে আয়ত্তে আনতে সময় খুব বেশি লাগে না।
সময়ের দিকে না তাকিয়ে যেখানেই আছেন, সেখান থেকেই শুরু করুন। স্নাতক পর্যায়ের শেষের দিকে যেসব শিক্ষার্থী আছেন, তাঁরাও শুরু করতে পারেন প্রস্তুতি পর্ব। শুরুতে বিভিন্ন ব্যাংকের আগের প্রশ্নের ধরন দেখে ধারণাটা শক্ত করে নিলে বাকি পথ এগোনো সহজ হয়। ব্যাংকে নিয়োগপ্রক্রিয়া সাধারণত তিন ভাগে হয়। প্রথম দুটি ধাপ নকআউটভিত্তিক। শুরুতে বহুনির্বাচনী প্রশ্নোত্তর পর্ব বা এমসিকিউ, অপরটি লিখিত বা বর্ণনামূলক অংশ। সাধারণত, দুটি অংশের পরীক্ষা আলাদাভাবেই হয়। ব্যাংকভেদে পরীক্ষার সময় ও নম্বর বণ্টনে তারতম্য দেখা যায়। যথার্থ প্রস্তুতি থাকলে প্রাথমিক বাঁচাই ও লিখিত পরীক্ষার গণ্ডি পেরিয়ে আসে সাক্ষাৎকারের পালা।
সবার আগে প্রাথমিক বাছাই
চাকরিপ্রার্থীদের জন্য এটি টিকে লড়াই আর নিয়োগকর্তাদের কাছে এই বাদ দেওয়ার পদ্ধতি। এই অংশে ভালো করার জন্য সময় সচেতনতা, তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তা, সার্বক্ষণিক মনোযোগ ও মনোবল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া ভুল উত্তরের জন্য নম্বর কাটা হতে পারে বলে সাবধানতাও জরুরি। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সাধারণ জ্ঞান এবং কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি অংশ থেকে প্রশ্ন আসে। যে বিষয়ে দখল ভালো, পরীক্ষায় সেখান থেকেই উত্তর করা শুরু করুন। বাংলা-ইংরেজি উভয় অংশ থেকেই ২০টি করে প্রশ্ন থাকে। বাংলার সাহিত্য অংশ থেকে অধিকাংশ প্রশ্ন এলেও ইংরেজিতে সমার্থক শব্দ, বিপরীত শব্দসহ ব্যাকরণ অংশের প্রাধান্য থাকে। অ্যানালজি, বাক্যে ভুল নির্ণয়, বাক্য সম্পূর্ণকরণ, বাংলায় বানান বা বাক্য শুদ্ধীকরণ, প্রবাদ প্রবচন, বাগধারা, সন্ধি, সমাস, প্রকৃতি ও প্রত্যয়, এক কথায় প্রকাশ থেকে প্রশ্ন আসতে পারে। সহজ প্রশ্নে দ্রুত উত্তর দিয়ে সময় সাশ্রয় করা বুদ্ধিমানের কাজ। আনুপাতিকভাবে গণিতে বেশি সময় লাগে। গণিত ও অ্যাপ্টিটিউড টেস্ট মিলে এ অংশ থেকে মোট ৩০টি প্রশ্ন থাকে। সাধারণ গণিতের পাশাপাশি গাণিতিক বিশ্লেষণী ক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য অ্যাপ্টিটিউড টেস্ট অংশে গ্রাফ, ছক, টেবিল বা বর্ণনা দেওয়া থাকে, তা থেকে উত্তর দিতে হয়। আগে থেকেই ক্যালকুলেটর ছাড়া অঙ্ক সমাধানের অনুশীলন করলে পরীক্ষার সময় বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়।
এ ছাড়া কম্পিউটার প্রযুক্তির জন্য বাজারের যেকোনো বই আদ্যোপান্ত ভালোভাবে পড়ার পাশাপাশি দৈনিক পত্রিকার টেক বা প্রযুক্তি পাতা নিয়মিত পড়লে তা ফলপ্রসূ হয়। সমসাময়িক নানা বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকলে তা পরীক্ষায় কাজে আসে। সাধারণত, সাধারণ জ্ঞান অংশ থেকে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি মিলিয়ে ১০টি প্রশ্ন থাকে। এ অংশে ভালো করতে দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নিতে হয়। ভালো মানের বই ছাড়াও নিয়মিত পত্রিকা পড়া, বেতার-টেলিভিশনের সংবাদ শোনার অভ্যাস থাকলে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ হয়।
লিখিত অংশে চাই ভালো প্রস্তুতি
চাকরিপ্রাপ্তি বহুলাংশে নির্ভর করে লিখিত পরীক্ষার নম্বরের ওপর। প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকে আছেন মানে টুকিটাকি তথ্য আপনার দখলে; প্রস্তুতি ভালো। এবার ভালোভাবে উপস্থাপনার পালা। লিখিত পরীক্ষায় বাংলা ও ইংরেজিতে রচনা, সংক্ষিপ্ত অনুবাদ, প্যাসেজ থেকে প্রশ্নোত্তর, ভুল সংশোধন থাকতে পারে। এ বিষয়গুলো আগে থেকেই চর্চা করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। অন্তত একটি ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকা নিয়মিত পড়ার অভ্যাস করলে সহায়ক হয়। বিশেষ করে অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পাতা এবং সাম্প্রতিক কলামগুলো নিয়মিত পড়তে পারলে কাজে আসে; বিশ্লেষণী লেখার সক্ষমতা বাড়ে। এ ছাড়া দেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি), রপ্তানি ধারা, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স, রিজার্ভ, কৃষি পরিস্থিতি, দারিদ্র্য হ্রাস, শ্রমবাজার, বিনিয়োগ পরিস্থিতি প্রভৃতি অগ্রগতির তথ্য টুকে রাখুন, লিখিত অংশে কাজে লাগবে। গণিত অংশে অনেকের ভয় থেকেই যায়। কিন্তু এ অংশে ভালো নম্বর পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সাধারণত দশ নম্বরের তিনটি অঙ্ক করতে হয়। পারলে দশে দশ।
সাক্ষাৎকারে ভালো করলেই চাকরি
কারও সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে আপনি যেমনটি প্রত্যাশা করেন, তেমনভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করুণ? স্বভাবতই বোর্ডের সবাই আপনার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করবেন। পরিশীলিত, পরিপাটি, অকপটভাবে ভাইভা বোর্ডে নিজেকে উপস্থাপন করতে হলে বিষয়ভিত্তিক ধারণাটা স্পষ্ট থাকা চাই। তাহলে আত্মবিশ্বাসটাও ফুটে উঠবে। নিজের পরিচয়, শিক্ষা, বাড়তি পারদর্শিতা, আগ্রহ—এগুলো সহজভাবে নিজের মতো করে তুলে ধরতে পারলেই অর্ধেক কাজ হয়ে গেল। এখন আপনার শিক্ষার সঙ্গে ব্যাংকিং কাজের সম্পর্ক বা এই সেক্টরে আগ্রহের কারণ ইত্যাদি প্রশ্নের ব্যাখ্যা কীভাবে দেবেন, তা আগে থেকেই ঠিক করে রাখেন। পাশাপাশি চলমান অর্থনীতি, ব্যাংকিং পরিস্থিতি, তফসিল ব্যাংকের সংখ্যা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ—এসব বিষয়ে ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষার প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ভালো প্রস্তুতি আপনাকে অনেকখানি এগিয়ে নেবে চূড়ান্ত পর্বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক ও ক্যারিয়ারবিষয়ক লেখক নাজমুল হুদা।
No comments:
Post a Comment