লাহোর প্রস্তাবের প্রেক্ষাপটে বঙ্গভঙ্গ, মুসলিমলীগ এবং দ্বি-জাতিতত্ত্বের উপর নিবন্ধ লেখা হলো
বঙ্গভঙ্গঃ
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বঙ্গভঙ্গ ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে একটি অনন্য সাধারন ঘটনা। তদানীন্তন ভারতের সর্ববৃহৎ ‘বাংলা প্রদেশ’ নামক প্রদেশকে বিভক্ত করে ‘বঙ্গভঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশ নামে নতুন দুটি প্রদেশে বিভক্ত করাকে বঙ্গভঙ্গ বলে।
বঙ্গভঙ্গের কারণঃ
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের কারণ সমূহ আলোচনা করার পূর্বে ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বাংলাকে বিভক্ত করার পক্ষে যেসব দাবিও যৌক্তিকতা তুলে ধরেন সে সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন। নবাব সলিমুল্লাহর যুক্তিগুলো নিম্নরূপঃ-
১. তৎকালীন সময় হিন্দু সম্প্রদায় শিক্ষা ও সম্পদে অত্যন্ত অগ্রগামী ছিল বিধায় সরকারি চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যর কর্তৃত্ব তাদের হাতেই ন্যস্ত ছিল।
২. হিন্দু জমিদার শ্রেণী মূলত কলকাতায় বসবাস করতেন এবং পূর্ববঙ্গ থেকে অর্থ উপার্জন করে কলকাতায় ব্যয় করতেন।
৩. তৎকালে কলকাতা বাংলা প্রদেশের রাজধানী হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্পকারখানাগুলো কলকাতাকে কেন্দ্র করেগড়ে ওঠে এর ফলে যে সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হয় তা থেকে পূর্ববঙ্গের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হয়।
৪. রাজধানী কোলকাতা ছিল রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র এবং নেতৃত্ব ছিল হিন্দুদের হাতে।
৫. জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে হিন্দুদের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকা সকল সুযোগ-সুবিধা তারাই ভোগ করত। এক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায় ছিল পশ্চাৎপদ।
লর্ড কার্জন উল্লেখিত যুক্তিসমূহ ও বাস্তব সুবিধার কথা বিচার বিশ্লেষণ করে বঙ্গকে ভাগ করার উদ্যোগ নেন। তবে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন যে, ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গের পশ্চাতে মূলত প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কারণ মুখ্য ছিল। এ সম্পর্কে নিচে সবিস্তারে আলোকপাত করা হলো –
১। প্রশাসনিক কারণঃ
বঙ্গকে বিভক্ত করার প্রশাসনিক যুক্তি দেখিয়ে ১৯০২ সালে লর্ড কার্জন ভারত সচিবকে লিখেন যে, বঙ্গ প্রদেশের আয়তন ২,০০,০০০ বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা প্রায় ৭ কোটি ৮৫ লক্ষ। এ বিশাল আয়তন এবং বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাকে একজন প্রশাসকের পক্ষে সুচারুরূপে শাসন করা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে, প্রতিবেশী আসাম প্রদেশ ছিল অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র এবং জনসংখ্যা ছিল কম।এজন্য বাংলাকে বিভক্ত করে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিভাগ ও আসাম কে নিয়ে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে একটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করা হয় যার রাজধানী হয় প্রাচীন শহর ঢাকা।
২। রাজনৈতিক কারণঃ
বাংলাকে বিভক্ত করার পশ্চাতে আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল রাজনৈতিক। রাজনৈতিক কারণের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো হলো –
জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষঃ
১৮৮৫ সালের ভারত দরদী ইংলিশ স্যার অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম এর নিরলস প্রচেষ্টায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ভারতের হিন্দু সমাজ সচেতন হয়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তুলে। এতে ব্রিটিশ সরকার হকচকিত হয়ে প্রশাসনিক সংকটে পড়ে যায়। এরূপ জাতীয়তাবাদী চেতনা ও সন্ত্রাসবাদি আন্দোলনকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার বাংলাকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ভাগ কর ও শাসন করঃ
ব্রিটিশ সরকার Divide and rule নীতিতে বিশ্বাসী। তাই বাংলাকে বিভক্ত করে একটি সম্প্রদায়কে নিজেদের অনুকূলে রেখে অপর সম্প্রদায়কে শাসন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
মুসলমানদের উন্নতি সাধনের প্রয়াসঃ
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে মুসলমান সামন্ত শ্রেণি মুসলমানদের স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। অপরদিকে স্যার সৈয়দ আহমদ আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানদের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা চালান। ফলে ব্রিটিশ সরকার তাদের স্বার্থ সম্বন্ধে সচকিত হয়ে ওঠে।
৩। অর্থনৈতিক কারণঃ
তৎকালীন প্রেসিডেন্সির (বাংলা, উড়িষ্যা, বিহার ও ছোটনাগপুর) রাজধানী কলকাতাকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে। পূর্ব বাংলায় পাট উৎপন্ন হলেও পাটকলগুলো গড়ে ওঠে কলকাতায়। ফলে কলকাতা অল্পদিনের সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে থাকে। এরূপ অবস্থায় হাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্রসচিব মি. রিজালী প্রশাসনিক ও রাজস্ব আদায়ের সমস্যার কথা উল্লেখ করে বড়লাটকে পত্র লেখেন। উক্ত পত্রের যৌক্তিকতা বিচার করে বাংলা ভাগ করা হয়।
৪। সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক কারণঃ
হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সামাজিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় রীতিনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই পূর্ববঙ্গের মুসলমানগন নিজেদের সামাজিক ও ধর্মীয় আদর্শ ভিত্তিতে নতুন প্রদেশের সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যাশা করে।
বঙ্গভঙ্গের ফলাফলঃ
বঙ্গভঙ্গের ফলাফল সাময়িক হলেও বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায় বেশি লাভবান হয়েছিল। নিচে বঙ্গভঙ্গের ফলাফল সবিস্তারে আলোচনা করা হলোঃ-
১। মুসলমানদের প্রতিক্রিয়াঃ
বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা নতুন প্রদেশের তথা ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ এর রাজধানী হয়। রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান অফিস-আদালত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ফলে মুসলমানগন নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা লাভে সক্ষম হয়। অফিস-আদালত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বড় বড় সুরম্য অট্টালিকা গড়ে ওঠায় ঢাকার শ্রী বৃদ্ধি ঘটে। বঙ্গভঙ্গ মুসলমানগন তাদের গৌরব ও মর্যাদা ফিরে পাবার আনন্দে মেতে ওঠে। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলার মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের দ্বার উন্মোচিত হয়।
২। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়াঃ
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দুদের অবস্থান ছিল খুবই কঠিন। বাংলার উচ্চ ও মধ্যবিত্ত হিন্দুরাই এর বিরুদ্ধে প্রচন্ড ঝড় তুলেছিল। কলকাতার আইনজীবী সমিতির মনে করলো বঙ্গভঙ্গের অর্থ নতুন প্রদেশ হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা করা।
৩। মুসলিম লীগের জন্মঃ
নতুন প্রদেশের অস্তিত্ব রক্ষা এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে ১৯০৬ সালে ঢাকায় ‘মুসলিম লীগ’ নামক রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয়।
৪। স্বদেশী আন্দোলনঃ
বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য হিন্দু জনগণ এবং কংগ্রেস স্বদেশী আন্দোলনের ডাক দেয়। আন্দোলনকারীরা বিলেতি দ্রব্য বর্জন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত বর্জনের ডাক দেয়। ফলে কলকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
৫। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতিঃ
বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ খুশি হলেও হিন্দু সম্প্রদায় খুশি হয়নি। এজন্যই বঙ্গভঙ্গ রোধ করার জন্য হিন্দু জনগণ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের সৃষ্টি হয়।
৬। ঢাকার উন্নয়ন ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেনঃ
দীর্ঘদিন পর ঢাকা আবার রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। ঢাকার প্রাদেশিক রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে এখানে হাইকোর্ট ভবন, সেক্রেটারিয়েট ভবন, আইনসভা ভবন নির্মাণ, পুরনো ভবন ও রাস্তাঘাট সংস্কার এবং নতুন নতুন প্রশাসনিক ভবন রাস্তাঘাট নির্মিত হতে থাকে। ফলে ঢাকার ক্ষমতা মর্যাদা প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়।
৭। শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নয়নঃ
বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের শিক্ষার উন্নয়নের সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। উচ্চ শিক্ষার উন্নয়নে সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজ কে সরকারিকরণ, জগন্নাথ কলেজকে প্রথম শ্রেণীতে উন্নতিকরণ, বেসরকারি কলেজগুলোর অনুদান প্রদান, মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়ন এবং নতুন নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়।
মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ও গুরুত্বঃ
মুসলিম লীগঃ
ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ভারতের মুসলমানগন কংগ্রেসের সদস্য হিসেবে কাজ করতে থাকে। কিন্তু কংগ্রেসের বড় নেতারা মুসলমানদের জাতীয়তাবোধ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন এবং মুসলমান বিরোধী কার্যকলাপ শুরু করেন। এ অবস্থায় ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করেন কংগ্রেসের মাধ্যমে তাদের স্বার্থ রক্ষায় সম্ভব হবে না।কি অবস্থায় মুসলমানদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার আদায়ের লক্ষে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠন করা হয়।
প্রেক্ষাপট ও গুরুত্বঃ
মুসলিম লীগ একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মুসলমানদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সংগঠনের জন্ম হয়। এর সংগঠনের আলো ভাবের পেছনে যেসব গঠনেও কারণ নিহিত ছিল তার নিচে তুলে ধরা হলো-
স্যার সৈয়দ আহমদ খান এর ভূমিকাঃ
ঐতিহাসিক আলীগড় আন্দোলনের নেতা এবং উপমহাদেশের বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব স্যার সৈয়দ আহমদ খান ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক লক্ষ্য উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অনেক আন্দোলন সংগ্রামে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। তিনি মুসলমানদের ভারতীয় কংগ্রেস এ যোগদান এর বিরোধিতা করেন। কারণ তিনি অনুভব করেন যে কংগ্রেসের মাধ্যমে মুসলমানদের স্বার্থের প্রতিফলন ঘটবে না। আবার কংগ্রেসের কতিপয় মুসলমান বিরোধী কর্মকাণ্ডের ফলে কংগ্রেসে মুসলমানদের যোগদান আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পায়।
মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন নীতি স্বীকৃতঃ
১৯০৬ সালের অক্টোবর মাসে আগা খানের নেতৃত্বে কতিপয় মুসলমান প্রতিনিধি ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেলের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তারা মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি জানান। গভর্নর-জেনারেল সহানুভুতির সাথে উক্ত দাবির বিবেচনা করেন। এতে উৎসাহিত হই মুসলমানগন একটি মুসলিম সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
সর্বভারতীয় শিক্ষা সম্মেলন ও মুসলিম লীগের জন্মঃ
১৯০৬ সালে ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে ঢাকায় All India Muslim Education Conference অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন শেষে নবাব ভিখারুল মুলক এর সভাপতিত্বে একটি রাজনৈতিক সভার আয়োজন করা হয় । উক্ত সভায় ভাষণে তিনি বলেন, মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ করে ভারতীয় কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি তারা লক্ষ্য করেছেন এবং তা বঙ্গভঙ্গের সময় সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়।
মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন প্রয়োজন এবং ব্রিটিশ সরকার তা দিতেও সম্মত হয়েছেন কিন্তু এর পূর্বে যা প্রয়োজন তা হলো একটি সংগঠন গড়ে তোলা।
দ্বিজাতি তত্ত্ব ও তাৎপর্যঃ
ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে ভারতকে রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত করার নির্ণায়ক আদর্শাশ্রয়ী একটি রাজনৈতিক মতবাদ। ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসন অবসানের প্রাক্কালে বিশ শতকের চল্লিশের দশকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের ধারণার উন্মেষ ঘটান।এ তথ্যের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বই ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের ভিত্তি তৈরি করেছিল । কংগ্রেস সভাপতি পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু ঘোষণা করেন যে, ভারতীয় উপমহাদেশে কেবল দুটি দলের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। একটি হলো কংগ্রেস এবং অপরটি হলো সরকার এবং বাকি দলগুলো কংগ্রেস অন্তর্ভুক্ত। মুসলমান মৃত্যুদণ্ড অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হিন্দু-মুসলিম সমস্যা সমাধানের জন্য হিন্দু নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনা করেও ব্যর্থ হন। পরে জিন্নাহ উপলব্ধি করেন যে হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে ঐক্যবদ্ধ থাকলে মুসলমানের স্বার্থ রক্ষা পাবে না।
১৯৪০ সালের ২২ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ দ্বিজাতি তত্ত্বের ব্যাখ্যা তুলে ধরেন এভাবে, ভারতবর্ষের দুটি পৃথক জাতির বসবাস হিন্দু ও মুসলমান মুসলমানের কৃষ্টি স্বতন্ত্র, কালচার স্বতন্ত্র, আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বতন্ত্র, তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও স্বতন্ত্র।সুতরাং জাতীয়তা যেকোনো মানদণ্ড অনুযায়ী ভারতের মুসলমানরা একটি জাতি। এভাবে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরা হয়। যার প্রতিফলন ঘটে ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে। পরবর্তীতে এ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতেই ১৯৪৭ সালেপাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
লাহোর প্রস্তাবের বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্যঃ
লাহোর প্রস্তাবঃ
১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলনে বাংলার কৃতি সন্তান শেরে বাংলা একে ফজলুল হক যে প্রস্তাব পাস করেন সে প্রস্তাব লাহোর প্রস্তাব নামে খ্যাত।লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়, ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সন্নিহিত স্থানসমূহকে অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। প্রয়োজনমতো সীমা পরিবর্তন করে যেসব স্থানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেসব অঞ্চলসমূহের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।এসব স্বাধীন রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত সার্বভৌম। রাহুল প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪আগস্ট ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি রাষ্ট্রের রূপান্তরিত হয়।
বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্যঃ
১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে All India Muslim League -এর ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নির্ধারণে জন্য যে অধিবেশন আহ্বান করা হয় ঐ অধিবেশনের লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়।
নিচে লাহোর প্রস্তাবের মূল বৈশিষ্ট্য সমূহ তুলে ধরা হলো –
১. ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে এর উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা গুলো নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন করতে হবে।
২. উল্লিখিত স্বাধীন রাষ্ট্র সমূহের অধীন ইউনিট বা প্রদেশগুলো স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম হবে।
৩. ভারতের অন্যান্য হিন্দু অঞ্চলগুলোর সমন্বয়ে পৃথক হিন্দু রাষ্ট্র গঠিত হবে।
৪. সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েরপ্রস্তাবের তাৎপর্য সাথে পরামর্শ ভিত্তিতে তাদের স্বার্থ অধিকার ও রক্ষার জন্য সংবিধানের পর্যাপ্ত ক্ষমতা রাখতে হবে।
৫. প্রতিরক্ষা, পরস্বরাষ্ট্র ও যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয়ে ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট অঙ্গরাজ্যগুলোর উপর ন্যস্ত থাকবে।
তাৎপর্যঃ
ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব অবিভক্ত ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করে। লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হবার পর মুসলিম লীগের রাজনীতিতে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ উপস্থিত হয়।
মুসলমানের মধ্যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা বোধ জাগ্রত হয়। অপরদিকে হিন্দুরা লাহোর প্রস্তাবকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। গান্ধীর মতে, লাহোর প্রস্তাব মেনে নেওয়ার অর্থ ‘ভারতকে ব্যবচ্ছেদ করা ‘এবং তা হবে একটি’ পাপ কাজ’।
জওহরলাল নেহেরু বলেন, লাহোর প্রস্তাব মেনে নিলে ভারত বই পড়বে বলকান রাষ্ট্র গুলোর ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত কর্তৃত্ববাদী পুলিশী রাষ্ট্র। লাহোর প্রস্তাব কে মুসলিম লীগ বিরোধী পত্রিকাগুলো ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ বলে অভিহিত করে সমালোচনা শুরু করে। তাদের অপবাদই পরে মুসলিম লীগের জন্য সুবাদে পরিণত হয়। লাহোর প্রস্তাব ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে পরিচিতি অর্জন করে। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়।
No comments:
Post a Comment